Homeপঞ্চাশ হাজার টাকা আর দুই সেলাই মেশিনে  মুক্তার বাজিমাত

পঞ্চাশ হাজার টাকা আর দুই সেলাই মেশিনে  মুক্তার বাজিমাত

থেমে গিয়েও হেরে যান নি, আসলে হারের কাছে মাথা নত করেন নি হাসিনা মুক্তা। স্বামীর মৃত্যুতে দুই মেয়ে নিয়ে ভীষণ দিশেহারা হয়ে পরেন, কিন্তু অদম্য ইচ্ছাশক্তি মুক্তাকে প্রেরণা যুগিয়েছে। ধৈর্য্য আর কাজের প্রতি একাগ্রতাই তাকে দেখিয়েছে সফলতার পথ। যুব উন্নয়ন থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা লোন আর দুটি সেলাই মেশিন দিয়েই বাজিমাত করেন উদ্যোক্তা হাসিনা মুক্তা।

উচ্চ মাধ্যমিকে পড়া অবস্থায় যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে পোশাক তৈরী এবং ব্লক-বাটিকের ওপর ট্রেনিং নিয়েছিল এবার বিষয়টাকে কাজে লাগানোর পালা। তাইতো মাস্টার্সে ফার্স্ট ক্লাস থাকা সত্ত্বেও কোনো চাকুরীর পেছনে না ছুটে, চিন্তা ছিল নিজেই কিছু করবেন।

হাসিনা মুক্তা উদ্যোক্তা বার্তাকে বলেন, উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর আমার বিয়ে হয়ে যায়। স্বামীর ইচ্ছা ও প্রবল অনুপ্রেরণাতেই অনার্সে ভর্তি হই। মাস্টার্স কমপ্লিট করি ফার্স্ট ক্লাস নিয়ে। কিন্তু রেজাল্ট হবার দুই মাসের মাথায় স্বামীর মৃত্যুতে দুই মেয়ে নিয়ে ভীষণ দিশেহারা হয়ে পরি, এক প্রকার বলা যায় দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায়, কিন্তু মনোবল হারায়নি, ২০০৯ সালে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে মাত্র পঞ্চাশ হাজার টাকা লোন নেই,  শ্বাশুড়ির দেয়া ১টি সেলাই মেশিন আর নিজে কিনি আরেকটি। সাথে কিছু কাপড় আর এক সহকর্মী নিয়ে  শুরু করি ‘নতুনত্ব বুটিকস ও হস্তশিল্প’। যার প্রধান আইটেম ছিল বাচ্চাদের পোষাক। মেয়ে ভিকারুন্নেসা স্কুলে পড়ায় মেয়েকে তৈরি করে দেয়া পোশাক নজর কাড়তো স্কুলের অভিভাবকদের। অর্ডার প্রথম সেখান থেকেই আসা। তাদের চাহিদা ও অনুপ্রেরণাই সাহস জোগায় বড় পরিসরে কাজ শুরু করার।

তিনি বলেন, স্কুলের অর্ডারের পাশাপাশি বেইলী রোড এলাকার মেলায় অংশ নিয়ে, ব্যাপক সাড়া পাই। ধীরে ধীরে কাজের এবং কর্মীর সংখ্যাও বাড়ে। দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্যাটার্ন মেকিং, হস্তশিল্প, স্কিন প্রিন্ট, কারচুপি, জুট প্রোডাক্ট তৈরি এসবের উপর প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু করি। মেয়ের স্কুলে অনেক অভিভাবক বাচ্চাদের স্কুলে দিয়ে অভিভাবক রুমে সময় কাটান, আমি ভাবলাম কী করে তাদের এই সময়কে কাজে লাগানো যায়। তাদেরকে আর্ট এন্ড ক্রাফটের উপর ফ্রি প্রশিক্ষণ দিলাম। আমার অনুপ্রেরণায় স্কুলের নারী অভিভাবকরা নিজেদের অলস সময়কে কাজে লাগাতে শুরু করে।

উদ্যোক্তার সফলতার গল্প দেখুন ইউটিউবে-দেখতে ক্লিক করুন

২০১৪ সালে এসএমই ফাউন্ডেশন আয়োজিত ২য় জাতীয় এসএমই মেলায় অংশ নিয়ে মুক্তা জানতে পারেন এসএমই ফাউন্ডেশনের  আরো প্রশিক্ষণের কথা। সে বছরই এসএমই ফাউন্ডেশনের ডিজাইনিং কোর্স এ ভর্তি হলেন মুক্তা, সফলতার সাথে ৩টি পর্ব পার করে এবং জাতীয় জাদুঘরে নিজের পণ্য প্রদর্শনের সুযোগ অর্জন করে নেন তিনি।

২০১৪ সালের নভেম্বর মাসে সফল আত্মকর্মী হিসেবে প্রথম স্থান অধিকার করে জাতীয় যুব পুরস্কার অর্জন করে মুক্তা। এছাড়াও পান স্বাধীনতা পুরস্কার, নেলসন ম্যান্ডেলা পুরস্কার, কবি নজরুল সম্মাননা, কলকাতায় পান গুনীজন সম্মাননা।

হাসিনা বলেন, ছোটবেলা থেকেই ফেলানো অনেক জিনিস দিয়ে অনেক কিছু তৈরি করতাম, সেগুলো পরিবারের সবাই, আশেপাশের মানুষ দেখে খুব প্রশংসা করতো।  স্কুলে গার্হস্থ্য বিজ্ঞান ক্লাসে যখন কিছু তৈরি করতে দিতো, সেখানেও শিক্ষকরা খুব প্রশংসা করতেন এবং উৎসাহ দিয়ে বলতেন যদি চেষ্টা থাকে, তবে খুব ভালো কিছু করতে পারবো। একটা সময়ে যখন নিজের পোষাক নিজেই তৈরি করে পরতাম তখন সকলেই জানতে চাইতো যে কোথা থেকে পোশাকটি কিনেছি এবং যখন বলতাম নিজে তৈরি করেছি, তখন তারাও প্রশংসা করতো। ছোট ছোট প্রশংসাগুলো আমার স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করার ইচ্ছেকে প্রবল এবং আমাকে উদ্যোক্তা হতে সহায়তা করেছিল।

চীন সরকারের আমন্ত্রণে  ২০১৫ সালে চীন সফরে যান মুক্তা।২০১৬ সালে মানিকনগরে  প্রথম শো-রুম দিলেন উদ্যোক্তা। এম্ব্রয়ডারি, ব্লক-বাটিক, কারচুপি, স্কিন প্রিন্ট এবং নিত্য নতুন ডিজাইন উদ্যোক্তার জন্য বয়ে আনল সুনাম। এছাড়া শো-পিস, বাচ্চাদের ও বড়দের বাহারি ডিজাইনের পোশাক তৈরি করে সবার কাছে সমাদৃত হন উদ্যোক্তা।

তরুণ উদ্যোক্তাদের পরামর্শ দিয়ে হাসিনা মুক্তা বলেন:   ব্যবসায়ের জন্য মূলধনই মূখ্য বিষয় নয়, বরং ইচ্ছেশক্তিটাই মূল। যদি ইচ্ছেশক্তি প্রবল থাকে তবে কোনো না কোনো ভাবে একজন উদ্যোক্তা কাজে সফলতা অর্জন করার দক্ষতা রাখে। একজন উদ্যোক্তা ধৈর্য্য থাকতে হবে, নতুন কিছু সৃষ্টি করার মানসিকতা রাখা এবং সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া।

তিনি আরো বলেন, কাজ করার দৃঢ় স্পৃহা থাকতে হবে এবং কোনো উদ্যোগের পরিকল্পনার সাথে সাথেই তা বাস্তবায়নের জন্য কাজে নেমে যেতে হবে। আমি মনে করি একটি সুষ্ঠু পরিকল্পনা বাস্তবায়ন এবং কাজের গুণগত মান বিষয়ে সচেতন থেকে, কোনো ছাড় না দিয়ে কাজ করলে একজন উদ্যোক্তা সফলতার পথে এগিয়ে যেতে পারবে।

বাচ্চাদের পোশাক, ফ্রক, থ্রি-পিস, স্কার্ট, টপস, বড়দের থ্রি-পিস, ওয়ান পিস, গাউন, কোটি, বোরখা, থাই ক্লে দিয়ে ঘর সাজানোর বিভিন্ন শো-পিস, অর্নামেন্টস, পুথি, পাট, নেট, কাগজ ফেলে দেয়া জিনিস দিয়ে শো-পিস সহ আজ প্রায় ৪০ টিরও বেশি প্রোডাক্ট লাইন। মাত্র ৫০,০০০ টাকা দিয়ে শুরু করে বর্তমানে সফল উদ্যোক্তা হাসিনা মুক্তা পরিচালনা করছেন প্রায় ৩৫ লাখ টাকার ব্যবসা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments