মো.আব্দুল মজিদ

১৯৭২ সাল, নদী ভাঙনে সিরাজগঞ্জ থেকে উঠে এসে পঞ্চগড় জেলার দেবীগঞ্জ উপজেলার সুন্দরদিঘী ইউনিয়নের মোটা সন্ন্যাসী তাঁতিপাড়া গ্রামে আশ্রয় নেয় ১৯টি পরিবার। তাঁত পেশার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সব গুলো পরিবার। একারণে এই পাড়াটিকে ১৯ ঘর তাঁতি পাড়া বলা হয়।

এই পাড়ার মেধাবী এক তরুণ মো.আব্দুল মজিদ। মেধা থাকা স্বত্তেও অভাব-অনটনের সংসারে অর্থকষ্টে পঞ্চম শ্রেণির বেশী আর লেখাপড়া করার সুযোগ হয়নি মজিদের। কখনো অনাহারেও দিন পার করতে হয়েছে তাকে। দু’মুঠো খাবার জোগাতে ছুটে বেড়িয়েছেন নানান জায়গায়। এক পর্যায়ে তাঁত শ্রমিক হিসেবেই কাজ শুরু করেন মজিদ। অনেক বছর কাজ করেছেন, ছুটে বেড়িয়েছেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তের তাঁত পল্লিতে। সব অভিজ্ঞতা আর প্রশিক্ষণকে কাজে লাগিয়ে শেষে নিজ গ্রামেই প্রতিষ্ঠা করেন তাঁত শিল্প । শুরু হয় মজিদের নতুন অধ্যায়, শুরু হয় দিন বদলের গল্প।

উদ্যোক্তা বার্তা টিম সরজমিনে গিয়েছিল তার কারখানায়। কথা হয় এবং ঘুরে দেখা হয় তার কারখানাসহ পুরো তাঁতপল্লী। ২০০৬ সালে আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে চার শতক বসত ভিটার এক কোণে টিনের চালার ঘরে মাত্র চারটি তাঁতে গড়ে তোলেন ‘টাচ ফ্যাশন’ নামের তার কারখানা। পাঁচ ভাই ও এক বোনসহ ছয় জন নিয়ে শুরু করেন শাড়ি এবং ওড়না তৈরির কাজ আর বিক্রির জন্য ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নমুনা সরবরাহ করেন মজিদ। নতুন ডিজাইনে বৈচিত্র্যময় তাঁতের শাড়ি ও ওড়না তৈরি করায় মজিদের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে খুবই দ্রুত। এরপর দ্রুতই বাড়তে থাকে কারখানার প্রচার প্রসার।

মজিদ শুধু নিজে স্বাবলম্বী হননি, গ্রামের অসহায় বেকার সাধারণ নারী-পুরুষদেরও নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখিয়েছেন। ঘুমিয়ে পড়া তাঁতপল্লীকে আবার জাগিয়ে তোলেন তিনি একাই। কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে বেকারত্ব দূর করে স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলেছেন তাদের। তাকে অনুসরণ করে এই গ্রামের অধিকাংশ বাড়িতেই এখন দুয়েকটা করে তাঁত গড়ে উঠেছে।

মজিদের এখন তিনটি কারখানায় প্রায় ৮০টির মতো তাঁত। যেখানে কাজ করছেন দুই শতাধিক মহিলা ও পুরুষ কর্মী। তারা তৈরী করছেন হাফ সিল্কের শাড়ি, মসলিন ডিজাইনে শাড়ি, কটন চুমকি শাড়ি, এনডি কটন শাড়ি, ওড়না, চুমকি ওড়না, কামিজ, থান কাপড়সহ বিভিন্ন ধরনের পোশাক তৈরি হয়। নিত্য নতুন ডিজাইন, কারুকাজ খচিত, মানসম্পন্ন ও সৌন্দর্যের কারণে মজিদের ‘টাচ ফ্যাশন’-এর তৈরি রেশমি শাড়ি ও ওড়নার চাহিদা তৈরি হয়েছে ব্যাপক ভাবে।

আব্দুল মজিদ জানান, ‘জন্মের পর থেকেই আমি বাসায় তাঁত দেখেছি। প্রথমদিকে কাজ শুরু করার পর শ্রমিক সংকটে পড়ি। এরপর গ্রামের বেকার যুবকদের ডেকে এনে প্রশিক্ষণ দিয়ে এ কাজ শেখাই। এ পর্যন্ত দুইশ’ বেকার নারী পুরুষকে আমি এ কাজ শিখিয়েছি। যাদের অনেকেই আমার কারখানাসহ দেশের বিভিন্ন তাঁত কারখানায় কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছে’।

আব্দুল মজিদ আরও জানান, ‘প্রথম দিকে আমাদের এই পাড়াতে সবাই তাঁতশিল্পের সাথে যুক্ত থাকলেও একটা সময় তারা অন্য পেশায় চলে যেতে থাকে। তখন আমি নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জেদে পড়ে যাই। নিজ উদ্যোগেই আমার সহ সকলের কারখানা আবার চালু করে দেই। সবাই মিলে এই তাঁত কারখানায় কাজ শুরু করি। পরবর্তীতে অনেককেই হাতে কলমে কাজ শিখিয়ে কারখানায় কাজ করার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছি। কেউ তাঁতে কাপড় বুনে, কেউ ডিজাইন করে, কেউ বা মেশিন অপারেট করে। এছাড়া সুতার চরকিতেও স্থানীয় অনেক মহিলা কর্মরত রয়েছেন। প্যাকেটিং, বিপণন ও তদারকিতেও অনেক কর্মী কাজ করেন’।

ঢাকার নামীদামী ব্রান্ডের শো-রুমে এসব শাড়ি বিক্রি হয়- হ্যান্ডমেড বিডি, ললনা, সাশ্রয়ী ফ্যাশন, নন্দনকানন, সাদাকালোসহ ঢাকার বিভিন্ন হ্যান্ডি ক্রাফট শোরুমে অর্ডারের ভিত্তিতে টাচ ফ্যাশন পণ্য তৈরী করে থাকে। এছাড়া পহেলা বৈশাখ, নববর্ষ, বসন্ত উৎসব, গায়ে হলুদ, বিয়ে সহ বিভিন্ন উপহারের শাড়িও অর্ডারের ভিত্তিতে তৈরি করা হয়ে থাকে। দেশের সেরা ফ্যাশন হাউস ও প্রতিষ্ঠানের চাহিদার ভিত্তিতে প্রতি সপ্তাহে সাত’শ থেকে আট’শ পিস শাড়ি সরবরাহ করা হয়। চাহিদা বাড়লে এ সংখ্যা কোনও কোনও সময় বেড়ে যায়।

ব্যক্তিগত জীবনে এক কন্যা ও এক পুত্রের জনক আব্দুল মজিদ। তার স্ত্রী সুরাইয়া বেগম কারখানার বিভিন্ন সেকশন দেখাশোনা করেন। সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণ পেলে কারখানার কর্মকাণ্ড আরও বৃদ্ধি করার ইচ্ছা আছে তার। স্টক করে রাখার মতো যথেষ্ট টাকা না থাকায় ব্যবসায় অতিরিক্ত মুনাফা করতে পারছেনা বলে তিনি জানান। টাকা থাকলে সারা বছরই চাহিদার অতিরিক্ত শাড়ি ও ওড়না তৈরি করে বাজারজাত করা সম্ভব হতো। এতে ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তির পাশাপাশি মুনাফাও বেশি হতো।

ঘুমিয়ে পড়া এক পল্লীকে সরব করে তোলা এক নায়ক আব্দুল মজিদ। সততা, নিষ্ঠা ও পরিশ্রমের কারণেই আজ তিনি একজন সফল উদ্যোক্তা। মজিদকে দেখে প্রতিনিয়ত অনুপ্রাণিত হচ্ছে অসংখ্য তরুণ। উন্নত জীবনের স্বাদ পেয়েছে সেই মহল্লা। দূর হচ্ছে বেকারত্ব। পঞ্চগড় সহ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ুক মজিদের এই কর্মযজ্ঞ। সুন্দর একটা সমাজে বসবাস করুক সবাই এটাই মজিদের আকুতি।

বিপ্লব আহসান

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here