শিক্ষক থেকে ঘড়ির ব্যবসায় এক হাজার কোটি টাকার মালিক

0

স্বপ্নকে ছেড়ে দিয়ে শুরু হয়েছিলো তার পথচলা। তিনি এমন একটি স্থানে বড় হয়েছিলেন, যেখানের মানুষের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে আয় কম করো ঠিক আছে তবে মাতৃভূমি ছেড়ে যাওয়া যাবে না। ছোট বেলায় চেয়েছিলেন পৃথিবী ঘুরে দেখতে, একজন বড় পাইলট হতে। তবে পরিবারের মানসিকতার কাছে স্বপ্নগুলোকে জলাঞ্জলি দিতে হয়েছিলো। নিজের স্বপ্নকে জলাঞ্জলি দেওয়া মানুষটির নাম হচ্ছে ওধবজী রাঘবজী প্যাটেল।

ওধবজী গুজরাটের এমন একটি শহরে বাস করতেন, যেখানে বেশিরভাগ লোকেরা সিরামিকের কাজে নিযুক্ত ছিলেন। সেখানে গুজরাটের মরবিতে একটি উচ্চ বিদ্যালয়ে বিজ্ঞান ও গণিতের শিক্ষকের চাকুরি করতেন। বিয়ের পর স্বাভাবিকভাবে পরিবারের সকল দায়-দায়িত্ব নিজের কাধে তুলে নেন।

সামান্য বেতনে চাকরি দিয়ে পরিবারের চার ছেলে এবং দুই মেয়ের ব্যয়ভার বহন করা তার কাছে দিনদিন কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে পড়ে। পরিবারের জন্য খাদ্য, পোশাক এবং শিক্ষা ব্যয়ে তিনি ক্রমশ হাঁপিয়ে ওঠেন।

কিন্তু তার স্ত্রী এই বিষয়টা স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিলেন যে, অতিরিক্ত আয়ের জন্য স্বামীকে চাকরির পাশাপাশি কিছু একটা শুরু করতে হবে। একদিন কথার ছলে বলে বসেন, “আপনি চাইলে অতিরিক্ত সময়টাতে ব্যবসা করতে পারেন? আমি যদি পুরুষ হতাম তবে ভাইয়ের সাথে ব্যবসা শুরু করতাম এবং পুরো শহর জুড়ে বিখ্যাত হয়ে উঠতাম।’’

স্ত্রীর দেয়া উৎসাহ এবং বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয়তা তাকে মুরবীতে একটি কাপড়ের দোকান খুলতে প্ররোচিত করেছিল। কিন্তু এই ব্যবসায়টা খুব কষ্টসাধ্য এবং সময়সাপেক্ষ ছিলো। ফলে আর ব্যবসায়টাকে বেশিদিন ধরে রাখতে পারেননি।

বয়স তখন ৪৫ এর কোঠায় তখন তিনি প্রায় ১ লাখ টাকা মূলধন নিয়ে প্রিটারশিপ ফার্ম তৈরি করেছিলেন এবং নাম দিয়েছিলেন অজন্তা ট্রানজিস্টর ক্লক (ঘড়ি) ম্যানুফ্যাকচারিং। সেই দিনগুলিতে, উত্তর ভারতের বেশিরভাগ ক্লক চালাতো ‘সাইন্সটিফ‘ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিযোগিতার বিষয়টা তিনি খুব ভালোভাবে সামলে নিয়ে ছিলেন। যেহেতু ‘সাইন্সটিফ‘ প্রতিষ্ঠানটি উওর ভারতে তাদের পণ্য বিক্রি করছে সেহেতু তিনি চিন্তা করলেন যে তিনি তার পণ্য দক্ষিণ ভারতে বিক্রি করবেন। তারপর শুরু করলেন মধ্যম ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে পণ্য বিক্রি এবং খুব কম সময়ে তারা দোকানেও পণ্য সরবরাহ করতে থাকে।

১৯৭৮ সালে হঠাৎ ঘড়ির বাজারে পরিবর্তন আসে। সবাই আস্ত আস্তে ডিজিটাল ঘড়ির ব্যবহার শুরু করে। নতুন কোয়ার্টজ প্রযুক্তি সম্পর্কে শেখার জন্য তিনি তাইওয়ান এবং জাপানে শিক্ষা অর্জন করতে যান। ততোদিনে বাইরে যাওয়ার লজ্জাবোধটা কেটে গিয়েছিলো। বিদেশের পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফিরে আসেন এবং ভারতকে প্রাচীন ঘড়ির পরিবর্তে নতুন যুগে ঘড়ির সাথে পরিচয় করিয়ে দেন।

১৯৮০ সালে, ফার্মটি সাশ্রয়ী মূল্যের ঘড়ি তৈরী শুরু করে। যেখানে ঘড়ি প্রতি খরচ হতো ৪৫ টাকা এবং বিক্রি হত ১০৫ টাকায়। এখান থেকে লাভ করা অর্থগুলো আবার বিনিয়োগ করেছিলেন অজন্তা,অরপার্ট এবং অরিভাতে। তাছাড়া তারা পেন্ডুলাম, সিরামিক ,উডেন ,গ্লাস এবং লোহার তৈরী ঘড়ি বানিয়েছিলেন। যা আজ পর্যন্ত ভারতের সবচেয়ে বিখ্যাত।

১৯৮৫ সালে, নারী ক্ষমতায়ন নিয়ে আলোচনা শুরুর অনেক আগেই প্রাচীর ঘড়ির জনক হিসাবে পরিচিত ওধবজী মহিলা কর্মীদের নিয়োগ দেওয়া শুরু করেন। আজ সংস্থাটি প্রায় দশ হাজার শ্রমিক নিযুক্ত রয়েছে যার মধ্যে আট হাজারের এরও বেশি মহিলা কর্মরত আছে।

সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা ওধবজী রাঘবজী প্যাটেল ২০১২ সালে মারা গেছেন। তিনি একটি ছোট্ট শহরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং নিজের বাড়ির বসে বিশ্বের বৃহত্তম ঘড়ির উৎপাদনশীল সংস্থা তৈরি করেছিলেন। বর্তমানে ঘড়িগুলির ক্রেতা প্রায় ৪৫ দেশে রয়েছে এবং কোম্পানির মূল্য দাঁড়িয়েছে এক হাজার কোটি টাকা।

ওধবজী আমাদের শিখিয়ে গেছেন মানুষের প্রতি আস্থা রাখতে এবং ধৈর্য্য ধারণ করতে ,সফলতা যত দেরিতে আসুক না কেন? তিনি সবসময় নিজেকে একজন অবসর প্রাপ্ত শিক্ষক হিসেবে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করতেন। কেউ যদি তাকে বলতেন আপনার পোশাক রুচি বাড়ান তখন তিনি বলতেন বারো’শ টাকার পেনশনে বেঁচে আছি।

মো.হৃদয় সম্রাট

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here