করোনার সময়টুকু কাজে লাগিয়ে অনলাইনে হয়ে উঠেছেন উদ্যোক্তা। তবে শুরুটা সহজ ছিল না। বার বার চেষ্টা করেও পুঁজির কারণে ব্যবসা শুরু করতে পারছিলেন না। শেষ পর্যন্ত টিউশনির আয়ের টাকা এবং স্বামীর সহযোগিতায় ব্যবসা শুরু করেন আসমা খাতুন।
বর্তমানে ফেসবুক পেজ ‘Homely Food’ ও ‘Blocker Mela’র মাধ্যমে ঘরে বসেই আয়ের পথ করে নিয়েছেন। নিজ জেলার ঐতিহ্যবাহী পোশাক এবং নিজের হাতে তৈরি সেমাইয়ে দারুণ চলছে তার ব্যবসা।
উদ্যোক্তা আসমা খাতুনের বাবা একজন গ্রাম্য ডাক্তার ছিলেন, মা গৃহিণী। ছয় ভাই-বোনের মধ্য তিনি পঞ্চম। গ্রামের বাড়ি নেত্রকোণা জেলার কলমাকান্দা উপজেলার এক অজপাড়াগাঁয়ে। সেখানেই বড় হয়েছেন। ডিগ্রি পাস করেছেন ঢাকার সিদ্ধেশ্বরী ডিগ্রি কলেজ থেকে।
বিয়ের পর সন্তানেরা বড় হতে থাকলে ধীরে ধীরে খরচ বাড়তে থাকে। স্বামী প্রাইভেট কোম্পানিতে জব করেন, বেতন খুব একটা বেশি না। আসমা খেয়াল করেন, সংসারের খরচ সামলাতে স্বামী হিমশিম খাচ্ছেন। চিন্তা করেন কিছু করা দরকার। সেই চিন্তা থেকে একটা স্কুলে চাকরি শুরু করেন। কয়েকটা টিউশনও যোগাড় করে নেন। কিন্তু সংসার, ছেলেমেয়ের স্কুল, কোচিংয়ে দৌড়াদৌড়ি, নিজের স্কুল, টিউশন, আবার ছেলেমেয়ের পড়াশোনা সবকিছু একা হাতে কুলিয়ে উঠতে পারছিলেন না।
আসমা খাতুন বলেন: আমি ৭ তালায় থাকতাম। দিনে ৪/৫ বার নামা উঠা সম্ভব হচ্ছিল না। তারপর জব ছেড়ে দিলাম, টিউশন কয়েকটা রাখলাম। বাসায় তেমন কেউ ছিলেন না যার কাছে সন্তানদের রেখে যেতে পারি। দুপুরে ওদের খাইয়ে, ঘুম পাড়িয়ে আমি চলে যেতাম টিউশনিতে। ওদের ঘরে তালা দিয়ে রেখে যেতে হতো। বাচ্চাদের বাবা তাড়াতাড়ি অফিস থেকে চলে আসতেন। কিন্তু তবুও দুই ঘন্টা ওরা একা থাকতো ঘরে। আমি টেনশনে থাকতাম, কিন্তু কিছু করার ছিল না।
“একদিন আমি তাড়াতাড়ি চলে আসি, কোন একটা টিউশন অ্যাবসেন্স ছিল তাই। এসে ঘরের তালা খুলে দরজা খুলতেই মেয়ের কান্না শুনতে পাই। আমার তখন প্রাণ উড়ে যাওয়ার অবস্থা। দৌড়ে মেয়ের কাছে এসে মেয়েকে জড়িয়ে ধরেছি। কিন্তু সেদিন আমার এতো খরাপ লেগেছিল যে, আমি সবকিছু ছেড়ে দিয়ে ঘরে বসে যাই। তারপর থেকে ঘরে বসে কিছু করার ভাবনা আসে,” বলে জানান আসমা খাতুন।
ধীরে ধীরে অনলাইন বিজনেস নিয়ে কিছুটা জেনে নেন। ২০১৯ সালে অনলাইনে বিজনেস শুরুর কথা ভাবেন। ভালো মোবাইল ছিল না তার। নিজের একটা ডিপিএস ভেঙে একটা মোবাইল কিনলেন। কিছু পোশাক নিয়ে আসলেন। সাথে সাথে পেজও খুলে নেন। কিনে আনা পোশাকগুলোর ছবি আপলোড দিলেন, কিন্তু কোন সাড়া পান না বহুদিন। তখন উই প্লাটফর্মের দেখা পেলেন। রাজিব নামে এক ভদ্রলোকের খোঁজ পেলেন। তিনি ছিলেন গ্রুপের মেন্টর। উইতে দ্রুত যোগ দেন আসমা। অনলাইন আড্ডাগুলো থেকে পেজ ও বিজনেস বিষয়ে অনেককিছু শিখতে পারেন। সেই শিক্ষা থেকে পেজ ডোমেইন কিনে নিলেন। কিন্তু কোন সেল নেই তখনও। ধৈর্য্য ধরে লেগে থাকলেন বিজনেস শেখার জন্য। অন্যদের ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প শুনতেন। স্কুল, কোচিংয়ে হেঁটে গিয়ে সেই টাকা জমিয়ে অনলাইন আড্ডায় অংশ নিতেন।
”ধীরে ধীরে বিজনেস থেকে হয়ে উঠলাম উদ্যোক্তা। টিউশনের ৫০০ টাকা দিয়ে হাতে তৈরি সেমাই তৈরি করে পরিচিতি পেলাম সেমাই আপু হিসেবে,” উদ্যোক্তা জীবনের শুরুর গল্পটা এভাবেই তুলে ধরলেন আসমা।
উদ্যোগ সম্পর্কে আসমা খাতুন বলেন: অনেকে হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যকে তুলে ধরছিলেন, নিজের জেলার বিখ্যাত পোশাক বা খাদ্য নিয়ে কাজ করছিলেন অনেকে। এগুলো দেখে অনেকটা অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম। সেই থেকে আমিও চেয়েছি আমাদের ট্র্যাডিশনাল পোশাকগুলো নিয়ে কাজ করবো। চেয়েছিলাম সবার সামনে আমাদের ঐতিহ্যকে তুলে ধরবো। এই চিন্তা ভাবনা থেকেই আমার উদ্যোগ।
তিনি বিজনেস শুরু করেছিলেন শেয়ারে। তার সাথে তার এক নিকটাত্মীয় বিনিয়োগ করেছিলেন। করোনার সময় তিনি আর থাকেননি। দু’জন মিলে ১০ হাজার টাকা দিয়ে শুরু করেছিলেন। নিকটাত্মীয় ব্যবসা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিলে আসমা খাতুনও প্রায় এক বছর কাজ বন্ধ রেখেছিলেন। পরে আবার করোনার মধ্যেই শুরু করে খাবারের দিকে একটু বেশি ফোকাস দেন। “আবার শুরু করি একদম শূন্য হাতে। খাবারে তেমন ইনভেস্ট করতে হয়নি।”
এখন উদ্যোক্তা হাতে তৈরি লাচ্ছা সেমাইয়ের সাথে ফ্রোজেন ফুড, রেগুলার ফুড, আচার, পিঠা, পায়েস, ঝালমুড়ির মশলা এ সব নিয়ে কাজ করছেন। থ্রি-পিস, শাড়ি, বিছানার চাদরও রয়েছে আসমা খাতুন কালেকশনে। কোন কর্মী বা ফ্যাক্টরি নেই। সম্পূর্ণ হোম মেড সবকিছু, হাইজিন মেইনটেইন করেন সর্বোচ্চ।
আসমার প্রতিষ্ঠান অনলাইনে একটা পরিচিতি পেয়েছে। ধীরে ধীরে এ পরিচিতি আরও বাড়বে আশা করেন তিনি। “যেহেতু শূন্য হাতে শুরু, তাই সবটাই আয়ের মধ্যে পড়ে। সব মাসে সমান আয় হয় না, কোন মাসে বেশি, কোন মাসে কম। তবে গড়ে ২০ হাজার আসে। নিজের প্রোফাইলে, বিভিন্ন গ্রুপে পণ্যের পরিচিতি তুলে ধরছি। এভাবেই ক্রেতারা তাদের প্রয়োজনীয় পণ্য নিতে পেজে ও ইনবক্সে অর্ডার দিয়ে থাকেন। কুরিয়ারের মাধ্যমে সেটা ক্রেতাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়। দেশের ভেতরে সবগুলো জেলাতেই আমার পণ্য কুরিয়ারের মাধ্যমে যাচ্ছে “
তিনি বলেন: মাসে আমি অর্ডার অনুযায়ী পণ্য উৎপাদন করে থাকি। খাবারের পণ্য কখনোই স্টোর করি না। যখন অর্ডার পাই, ফ্রেশ কিনে তৈরি করে দেই।
ভেজালমুক্ত ও স্বাস্থ্যকর বিষয়টা তার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। আসমা খাতুন বলেন, ‘আমাদের চারপাশে ভেজাল পণ্যের ছড়াছড়ি। লাচ্ছা সেমাই আমার খুব পছন্দ, কিন্তু বিভিন্ন নিউজে দেখি এটা কেমন নোংরা পরিবেশে, ভেজাল উপকরণ দিয়ে তৈরি করা হয়। যেসব ময়দা মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যায় সেগুলো লাচ্ছা কারখানায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়, এমন নিউজও মিডিয়ায় পেয়েছি। পোড়া তেল ও পোড়া ডালডায় ভাজা হয় ওইসব লাচ্ছা। মাছি ভনভন করে ময়দার ডোয়ের মধ্যে। সেগুলো দেখে খাওয়ার রুচি চলে যায়। তাই নিজে তৈরি করা যায় কিনা এটা নিয়ে রিসার্চ শুরু করি। তারপর নিজে ট্রাই করি। সবাইকে ভেজালমুক্ত খাবার দেওয়ার ইচ্ছা থেকেই এটা নিয়ে কাজ শুরু করি।’
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় পেজ দুটি আরও বড় পরিসরে সবার সামনে নিয়ে আসার ইচ্ছা আছে তার। ব্লকের মেলায় দেশীয় কিছু পণ্য অ্যাড করার চিন্তাও করছেন।
তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য তার পরামর্শ: কোন কিছু নিয়ে কাজ শুরু করার আগে অবশ্যই সেই কাজ নিয়ে ভালোভাবে জেনে, বুঝে শুরু করবেন। কাজটি অবশ্যই আপনার পছন্দের হতে হবে। তাহলে এগিয়ে যেতে পারবেন। ব্যবসায় পুরোপুরি সাফল্য পেতে ধৈর্যের সঙ্গে কাজ করতে হবে।
মেহনাজ খান,
উদ্যোক্তা বার্তা