কলেজ অব হোম ইকোনোমিকস থেকে শিশু বিকাশ ও সামাজিক সম্পর্ক বিভাগে পড়াশোনা। সেখানে ভর্তি হবার পর থেকেই শিশুর ভ্রূনাবস্থার বিকাশ থেকে শুরু করে তার জন্ম, বেড়ে উঠা, শৈশব, কৈশোরের নানান দিক নিয়ে হাতে কলমে শেখা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি সংক্রান্ত ফিল্ড ভিজিট, কেস স্টাডি, নার্সারিতে ক্লাস নেওয়া সবটাই যেন আনন্দের সাথে চলছিল।
পড়াশুনার পাশাপাশি চাইল্ড কেয়ার ও প্যারেন্টিং নিয়ে টুকটাক লেখা হতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। স্নাতক, স্নাতকোত্তর শেষ হবার আগ থেকেই যেন তাগিদ ছিল এতোদিন যা শিখেছেন তা বাস্তবজীবনে প্রয়োগ করার। বাস্তবতার নিরিখে নিজের ঘরে, নিজেদের শিশুদের বিকাশের জন্য কাজে মন ভরবার নয়, তাই প্রয়োজন সামাজিক উদ্যোগের।
ফারাহ তুবা সেই তাগিদেই ২০১৭ সালে যাত্রা শুরু করলেন ‘লাটিম’ নামের একটি সামাজিক উদ্যোগের সংগঠন। নিজেকে গড়ে তুললেন সামাজিক উদ্যোক্তা হিসেবে। শুরু থেকেই পরিবার সাথে ছিল। তবে যিনি উদ্যোক্তা তার কাঁধেই ছিল সবটা নিয়ে এগিয়ে যাবার পরিপূর্ণ দায়িত্ব।
পরিবারের সহায়তা অনুপ্রেরনার পাশাপাশি প্রয়োজন ছিল মূলধন ও কর্মসহযোগীর। সাথে জুটে গেল একদল তরুণ সেচ্ছাসেবক। স্বর্না, মৈত্রী, সঙ্গীতা, স্নিগ্ধা, দিনাদের প্রচেষ্টায় এগিয়ে যেতে থাকলো সামাজিক সংগঠন লাটিম। প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে বর্তমানে লাটিমকে সার্বক্ষণিক সহায়তা করছেন আশফাক কবির। এছাড়াও কমিনিউকেশন অফিসার হিসেবে কাজ করছেন ইফফাত হোসাইন।
বই খাতা কলমের সাথে সাথে আর যা কিছু শিশুর শিক্ষায় ব্যবহার করা হয় তার সবই শিক্ষা উপকরণ। শিক্ষক, পিতামাতা বা শিশুর সহযোগী যে কারো একটু ব্যতিক্রমী চিন্তাধারায় প্রস্তুতকৃত শিক্ষা উপকরণ শিশুর শিক্ষায় আনতে পারে ভিন্নধর্মী মাত্রা। এতে করে শিশুর সৃজনশীলতার জগতকে যেমন বিস্তৃত করা যায় তেমনি শিশুর শিক্ষাগ্রহণ হয় আনন্দের। সুপ্ত মেধা ও প্রতিভার সমন্বয়ে যা শিশুর বুদ্ধিমত্তাকে প্রশমিত করবে নিঃসন্দেহে।
ফারাহ তুবা উদ্যোক্তা বার্তাকে বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে উন্নত বিশ্বের শিক্ষাব্যবস্থার কথা চিন্তা করলে দেখা যায় আমাদের সনাতনী পদ্ধতির সাথে মানিয়ে চলার জন্য শিশুদের জন্য বেশ ঝক্কি পোহাতে হচ্ছে। নতুন পদক্ষেপে শিশু বিকাশ নিয়ে কাজ অনেক হলেও সেখানে শিশুর শিক্ষা, প্রতিপালন, স্বাস্থ্য এবং পুষ্টির সমন্বয় হয়না। অথচ সামগ্রিকভাবে কিছুটা ভিন্ন উদ্যোগে আগালেই সেখানে শিশুদের সৃজনশীল জগতকে বিস্তৃত করবার বিশাল সুযোগ রয়েছে’।
তিনি বরেন, ‘এই অবস্থার পরিবর্তন আনয়নে কাজ করছে লাটিম। লাটিম মূলত তাদের তৈরী শিক্ষা উপকরন পৌছে দিতে চায় বাংলাদেশের সর্বত্র। বিভিন্ন সোশ্যাল এন্টারপ্রাইজ, এনজিও, ব্যক্তিগত উদ্যোগসহ বাংলাদেশের সকল স্কুলে সীমিত মূল্যে শিক্ষা উপকরণ পৌছে দিয়ে বাংলাদেশের শিশু শিক্ষাকে এগিয়ে নেওয়া লাটিমের প্রত্যয়’।
শিক্ষা উপকরন সম্পর্কে দেশের মানুষ জানুক বা না জানুক, শিশু বিকাশকে তরান্বিত করার জন্য টুকটাক সৃজনশীল উপকরন সবাইই বানান। ঘরে বসে বানানো এই উপকরণগুলো নিয়ে ইতোমধ্যে তারা প্রথমবারের মতো আয়োজন করেছে ‘শিক্ষা উপকরন প্রতিযোগিতা’।
সারাদেশ থেকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া দেড় শতাধিক তরুণ ও অন্যান্য আরো অনেকে এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছে। ছোট বাচ্চাকে ছেড়ে থাকতে ইচ্ছা করে না, কোথায় রেখে যাবো, কি হবে এসব দুশ্চিন্তায় মায়েদের সৃজনশীলতা গুলোও চাপা পড়ে যায়। লাটিমের এই প্রতিযোগিতার প্রথম রাউন্ডে মায়েদের অংশগ্রহণও ছিল চোখে পরবার মতো। প্রথম আয়োজনেই লাটিম সারাদেশ থেকে একক ও দলীয়ভাবে মোট ১৬৫ টি শিক্ষা উপকরণ পেয়েছে।
অনানুষ্ঠানিক শিক্ষার উন্নয়নের লক্ষ্যে শিক্ষা উপকরণ প্রতিযোগিতার আরো একটি লক্ষ্য হলো সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষায় সহায়তা করা। এরকম অনেক শিশু বাংলাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে যারা সবাই সমস্ত সুযোগ সুবিধা পাচ্ছে না। সেই সমস্ত সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষায় শিক্ষা উপকরণের অধিক ব্যবহার এর মাধ্যমে তাদের স্কুল ঝরে পড়া বন্ধ করে শিক্ষাকে ভালোভাবে তরান্বিত করা এই প্রতিযোগিতার অন্যতম লক্ষ্য।
সামাজিক সংগঠন লাটিমের এক ঝাঁক তরুণ উদ্যোক্তা জানালেন, লাটিম এমন একটি মাধ্যম হতে চায় যার মাধ্যমে শিশুর স্বাভাবিক বিকাশ নিশ্চিত করবে। সবার জন্য উন্নত শিক্ষার লক্ষ্যে শিক্ষা উপকরণ তৈরি, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ আর কারিকুলাম তৈরি নিয়ে লাটিম তার কার্যক্রম আরো ফলপ্রসূ করতে চায়। সকল ধরনের প্রতিষ্ঠান যারা শিশু বিকাশ নিয়ে কাজ করছে তাদের কে একই মাধ্যমে নিয়ে আসার উদ্দেশ্যে দেশব্যাপী কার্যক্রম পরিচালনা করাও লাটিমের লক্ষ্য।
‘‘পোস্ট পারটাম ডিপ্রেশন ও বয়সন্ধিকালীন কাউন্সেলিং অনলাইনে চালুসহ শিশুর প্রাথমিক শারীরিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারে অনলাইনে সাহায্য প্রদান নিয়েও আগাতে চায় ফারাহ তুবার ‘লাটিম’।’’
লাটিমের কাজের পাশাপাশি ফারাহ তুবা বর্তমানে ব্রাক ইউনিভার্সিটিতে ‘প্রারম্ভিক শিশু বিকাশ’ এর উপর দ্বিতীয় মাস্টার্স করছেন।
সাদিয়া রশ্মি সূচনা