কাঁঠাল উৎপাদনে বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। দেশে বছরে যে পরিমাণ কাঁঠাল উৎপন্ন হয়, তার প্রায় অর্ধেকাংশই নষ্ট হয়ে যায়। যার আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ বছরে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা।তবে কাঁঠালের বহু্বিধ ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি রোধের পাশাপাশি সারাবছরই “সুপারফুড” হিসেবে খ্যাত এই ফলটি খাওয়া সম্ভব। যা দেশের পুষ্টির চাহিদা মেটাতেও গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, দেশে বছরে ১৮ লাখ ৯৩ হাজার ৩০৩ মেট্রিক টন কাঁঠাল উৎপাদিত হয়। এবার ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার দিকে যাত্রা শুরু করছে এই কৃষি পণ্যটি।
পল্লি কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) কর্মকর্তাদের বরাতে জানা যায়, আইসল্যান্ড থেকে ৪ লাখ পিস কাঁঠালের বার্গারের ক্রয়াদেশ পায় বাংলাদেশ।
কাঁঠালের অপচয় রোধে এর বহুবিধ ব্যবহার নিশ্চিত করতে কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশনের (কেজিএফ) অর্থায়নে এবং নিউভিশন সলিউশন্স লিমিটেডের সহযোগিতায় ২০১৯ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত “কাঁঠালের সংগ্রহত্তোর ক্ষতি প্রশমন ও বাজারজাতকরণ কৌশল” শীর্ষক তিন বছর মেয়াদি একটি গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট।
ইতোমধ্যে বাংলাদেশে কাঁঠাল থেকে বিভিন্ন প্রকার মুখরোচক খাবার তৈরি হচ্ছে। যার মধ্যে রয়েছে- কাঁঠালের জ্যাম, আচার, চাটনি, চিপস, কাটলেট, আইসক্রিম, দই, ভর্তা, কাঁঠালস্বত্ব, রেডি টু কুক কাঁঠাল, ফ্রেশকাট (ভেজিটেবল মিট), কাঁঠালের পাউডারসহ আরও বিভিন্ন ধরনের প্যাকেটজাত পণ্য। বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো এসব পণ্য উদ্ভাবন করেছে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট। তাদের মতে, কাঁঠাল থেকে ৩০টিরও বেশি পণ্য উৎপাদন সম্ভব।
কাঁঠালের তৈরি পণ্যের বাজার বিস্তারে কাজ করছে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থা। বাণিজ্যিকভাবে কাঁঠালের রেসিপি নিয়ে কাজ করতে উৎসাহী হয়েছে পিকেএসএফ। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক কৃষি উন্নয়ন তহবিল থেকে আর্থিক সহায়তাও মিলেছে। সংস্থাটি তার কৃষি বাণিজ্যিকীকরণ এবং উদ্যোগ প্রচার প্রকল্পের অধীনে ১২৯ মিলিয়ন ডলার ঋণ প্রদান করছে।জাতিসংঘের এজেন্সি-সহায়তা প্রকল্পের অধীনে বাস্তবায়িত হওয়া ছোট আকারের প্রকল্পগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের কাঁঠালের বার্গার অন্যতম।
১৯৯৫ সালে প্রতিষ্ঠিত সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট ইনোভেশন অ্যান্ড প্র্যাকটিস (সিডিআইপি) নামের এনজিও প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। এনজিওটি বিনিয়োগ পেয়েছে ১.৮৯ কোটি টাকা; এরমধ্যে পিকেএসএফ ১.৪৪ কোটি টাকা এবং সিডিআইপি বাকি অর্থ প্রদান করেছে।
সারাবিশ্বে ভেজিটেরিয়ানদের (নিরামিষভোজী) কাছে এর চাহিদা থাকার ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে, ফলে রপ্তানিতেও তৈরি হয়েছে সম্ভাবনা।
ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, ভিয়েতনামসহ দক্ষিণ এশিয়ার বেশকিছু দেশে এবং ইউরোপের অনেক দেশে কাঁঠাল দিয়ে তৈরি নানা ধরনের প্রক্রিয়াজাত খাদ্যদ্রব্যের জনপ্রিয়তা রয়েছে। সেসব দেশে কাঁঠালজাত পণ্য রপ্তানিতে জোর দিলে দেশের অর্থনীতিতে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা যুক্ত হবে বলে প্রত্যাশা করা যায়।
বিশ্ববাজারে কাঁঠালের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে বিশেষ করে শুকনো ও প্রক্রিয়াজাত কাঁঠালের। ভারত, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনামসহ বিভিন্ন দেশ ইতোমধ্যেই এই বাজারে নিজেদের শক্ত অবস্থান তৈরি করেছে। বাংলাদেশও চাইলে এই প্রতিযোগিতায় নিজেদের কার্যকরভাবে যুক্ত করতে পারে। দেশের উর্বর ভূমি ও অনুকূল আবহাওয়া কাঁঠাল উৎপাদনের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। ফলে কাঁচামালের অভাব নেই। কিন্তু রপ্তানির জন্য কাঁঠালকে সঠিকভাবে সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাত করার সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। উন্নত প্রযুক্তি, যথাযথ প্যাকেজিং এবং আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে উৎপাদন করলে বাংলাদেশের শুকনো কাঁঠাল বিশ্ববাজারে সফলভাবে প্রবেশ করতে পারবে।
শুকনো কাঁঠালের প্রক্রিয়াজাতকরণ: বাংলাদেশের জাতীয় ফল কাঁঠাল, যা উৎপাদনে বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। ভারতের পরেই বাংলাদেশ কাঁঠাল উৎপাদনে শীর্ষ অবস্থানে আছে। প্রতি বছর বিশ্বে প্রায় ৩৭ লাখ টন কাঁঠাল উৎপাদিত হয়। যার মধ্যে ভারত উৎপাদন করে ১৮ লাখ টন, আর বাংলাদেশ উৎপাদন করে প্রায় ১০ লাখ টন।
পুষ্টিগুণে ভরপুর কাঁঠাল বাংলাদেশের খাদ্যতালিকায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এতে প্রচুর ফাইবার, ভিটামিন, প্রোটিন, খনিজ ও ক্যালরি রয়েছে। যা শরীরের জন্য অত্যন্ত উপকারী। গ্রাম থেকে শহর সব জায়গার মানুষই এই ফল খেতে ভালোবাসে এবং এটি পুষ্টির চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
কিন্তু সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের অভাবে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ কাঁঠাল নষ্ট হয়। এই সমস্যার একটি কার্যকর সমাধান হতে পারে শুকনো কাঁঠাল। যা দীর্ঘদিন সংরক্ষণযোগ্য, পুষ্টিগুণে ভরপুর এবং রপ্তানিযোগ্য একটি সম্ভাবনাময় পণ্য। বিশ্বব্যাপী শুকনো ফলের চাহিদা ক্রমশঃ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের বাজারে। কাঁঠাল তার স্বাদ, গুণগত মান ও বহুমুখী ব্যবহারের কারণে বৈশ্বিক খাদ্যশিল্পে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করতে পারে।
রপ্তানির জন্য পণ্যের মান নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভালো কৃষি চর্চা (GAP – Good Agricultural Practice) এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি (HACCP – Hazard Analysis and Critical Control Points) অনুসরণ করে এই মান বজায় রাখা সম্ভব। এসব পদ্ধতি নিশ্চিত করে যে পণ্যটি নিরাপদ, স্বাস্থ্যকর এবং আন্তর্জাতিক বাজারের মানদণ্ড অনুসারে উৎপাদিত হয়েছে।
বাংলাদেশ যদি আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে সঠিকভাবে শুকনো কাঁঠাল প্রক্রিয়াজাত করতে পারে তাহলে এটি আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান তৈরি করতে পারবে। এতে একদিকে কৃষকদের আয় বাড়বে, অন্যদিকে দেশের রপ্তানি আয়ও বৃদ্ধি পাবে। তবে মৌসুমি ফল হওয়ায় অধিকাংশ কাঁঠাল একসময়ে পাকতে শুরু করে, যার ফলে সংরক্ষণের অভাবে এর একটি বড় অংশ নষ্ট হয়ে যায়। অথচ সঠিক প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে এটি দীর্ঘ সময় সংরক্ষণযোগ্য এবং রপ্তানিযোগ্য একটি সম্ভাবনাময় পণ্য হয়ে উঠতে পারে।
সাফল্যের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ: শুকনো কাঁঠালের রপ্তানি সফল করতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
প্রথমতঃ কাঁঠালের গুণমান নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশের জন্য পণ্যের মান অবশ্যই উচ্চ স্তরের হতে হবে। আধুনিক প্রক্রিয়াকরণ প্রযুক্তি ব্যবহার করে কাঁঠালের গুণগত মান বজায় রাখতে হবে এবং আন্তর্জাতিক মান অনুসারে তা প্রক্রিয়া করতে হবে।
দ্বিতীয়তঃ বাজার গবেষণা অপরিহার্য। বিভিন্ন দেশের বাজারে শুকনো কাঁঠালের চাহিদা ও ক্রেতাদের রুচি সম্পর্কে সঠিক তথ্য সংগ্রহ করে রপ্তানি পরিকল্পনা তৈরি করা উচিত। এর মাধ্যমে উৎপাদন এবং বিপণন পরিকল্পনা আরও কার্যকর হবে।
তৃতীয়তঃ সরকার এবং বেসরকারি সংস্থাগুলোর সহযোগিতা শুকনো কাঁঠাল রপ্তানির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সরকারের সাহায্যে নীতি-নির্ধারণ, ভর্তুকি এবং প্রক্রিয়াকরণ ক্ষেত্রে সুবিধা দেওয়া গেলে এটি রপ্তানির খাতকে আরও শক্তিশালী করবে।
অবশ্যই আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে কাঁঠালের প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণে নতুন পদ্ধতি তৈরি করা যেতে পারে। যা উৎপাদন ব্যয় কমাবে এবং পণ্যের মান উন্নত করবে।
বর্তমানে সরকার ও বিভিন্ন উদ্যোক্তারা কৃষিভিত্তিক শিল্পের বিকাশে কাজ করছে যা শুকনো কাঁঠালকে আন্তর্জাতিক বাজারে পৌঁছে দিতে সহায়ক হতে পারে। সঠিক পরিকল্পনা, গবেষণা ও বিনিয়োগের মাধ্যমে এটি দেশের অর্থনীতির নতুন সম্ভাবনাময় রপ্তানি খাত হিসেবে গড়ে উঠতে পারে। শুকনো কাঁঠাল রপ্তানির মাধ্যমে একদিকে যেমন কৃষকদের আয় বৃদ্ধি পাবে, তেমনি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের নতুন সুযোগ তৈরি হবে। সরকারের সহযোগিতা, সঠিক বাজার গবেষণা এবং কার্যকর প্রচারণার মাধ্যমে শুকনো কাঁঠাল দেশের অর্থনীতিতে নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করতে পারে এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস হতে পারে।
সেতু ইসরাত,উদ্যোক্তা বার্তা