অসম্ভব সাহসী এক উদ্যোক্তা বয়সে খুবই তরুণ। এর মধ্যেই প্রায় এক যুগের সাফল্যমণ্ডিত ক্যারিয়ারও তৈরি হয়েছিল তার। শুরুটা ছিল গ্রামীনফোণে, সেখান থেকে একে একে নোকিয়া, এরিকসন, কিউবি- কোথায় ছিলেন না তিনি। যখন যেখানে দেখেছেন নিজের বিকাশের সুযোগ, লুফে নিয়েছেন। তবে এত বড় বড় জায়গায় কাজ করার পরেও তার মনের এক কোণায় একটা খটকা থেকেই যাচ্ছিল। ভাবছিলেন, যেসব জায়গায় কাজ করছেন, কতটুকু পদচিহ্ন ই বা তার থাকছে সেখানে। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনোটিই তার নিজের কিছু নয়, তাই সেগুলোর সাথে সেই অর্থে একাত্মতাও অনুভব করছিলেন না তিনি। এই চিন্তার দোলাচল থেকেই তিনি স্বপ্ন দেখছিলেন নিজেই কোনোকিছু প্রতিষ্ঠা করার, যেই প্রতিষ্ঠান দিয়ে তিনি নিজ হাতে কিছু একটা করতে পারবেন সমাজ কিংবা মানুষের জন্য।
কিন্তু কীভাবে সমাজকে বদলাবেন?
সমাজের কোন বিষয়ে তিনি কাজ করতে পারেন? মানুষের কোন সমস্যার সমাধান করবেন তিনি? সারাক্ষণই এসব চিন্তা ঘুরপাক খেতে থাকে তার মাথায়। সাধারণ মানুষের পরিস্থিতি বোঝার জন্য তিনি তাকালেন নিজের জীবনে উপলব্ধি করা সমস্যাগুলোর দিকে। কর্পোরেট জগতে থাকার কারণে তার সপ্তাহের প্রতিটি দিনই ছিল প্রচুর কর্মবহুল। তিনি তাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতেন শুক্রবারের জন্য, সেদিন হয়তো পরিবারের সাথে একটু নিশ্চিন্তে সময় কাটাবেন, নিজের কাজের ধকলকে ঝেড়ে ফেলে একটু আয়েশ করবেন। অথচ দেখা যেত, বেশিরভাগ সময়ই এই দিনটায় এসে তার বাসার ভাঙা জানালা বা পাইপের লিক ঠিক করার জন্য লোক খুঁজে বের করার মতো কাজগুলো করতে হচ্ছে। কখনো বা বাসা ডিপ ক্লিনের কাজ। খেয়াল করে দেখলেন, এ সমস্যা শুধু তার নয়, তার সব কলিগও এ ব্যাপারটি নিয়ে বেশ বিরক্ত। কারণ, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দৈনন্দিন জীবনের এইসব সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে পেশাদারিত্বের খুবই অভাব। না আছে সহজলভ্যতা, না আছে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা, না আছে কোনো ধরাবাধা দরদাম।
তিনি খেয়াল করলেন, এই সাধারণ সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য এখনো কোনো প্রতিষ্ঠানই এগিয়ে আসছে না। এটা নিয়েই ভাবতে থাকলেন। এরপর লক্ষ্য ঠিক করলেন প্রতিদিনের জীবনের এই ছোট্ট ছোট্ট সমস্যাগুলো তিনি সাধারণের জীবন থেকে একদম নাই করে দেবেন।
কিন্তু স্বপ্ন দেখা আর স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার মাঝখানের পথটা আসলে অনেক বন্ধুর। প্রথম কাজটা হয়তো অনেকেই করে, কিন্তু পথটা পাড়ি দেয় খুব কম কিছু মানুষ। তবে তাদেরকেই মনে রাখে ইতিহাস। হয়তো তেমনই কেউ হতে চেয়েছিলেন আমাদের গল্পের এই সাহসী মানুষটি। লক্ষ্য ঠিক করার পর তার মনে এসেছিল অনেক সন্দেহ নানা ধরনের ভীতি। তখন তিনি কিউবির মতো একটি নামকরা প্রতিষ্ঠানে ভালো পদে কাজ করছেন। মাসে মাসে একটি স্থির আয়ের উৎস আছে। পরিবার, বাবা-মা, দুই পুত্রের ভবিষ্যৎ সবই তার উপর নির্ভর করছে। এর মধ্যে তিনি যদি নিজে একটি প্রতিষ্ঠান শুরু করতে যান,তাহলে এই চাকরিটা তার ছেড়ে দিতে হবে। আয় হয়ে যাবে সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। তিনি তার বড় ভাইয়ের মতামত চাইলেন। তিনি বললেন, ‘তোমার যে গাড়িটা আছে সেটা হয়তো তোমার বিক্রি করে দিতে হবে। তোমার বাচ্চাগুলো যে মানের স্কুলে এখন পড়ছে সামনে হয়তো তারা আর পড়তে পারবে না। এই ঝুঁকি নেবার জন্য কি প্রস্তুত তুমি? শুনে তিনি আরো দু’মাস সময় নিলেন। তারপর একসময় চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে নেমে পড়লেন কাজে। এমনকি কিউবির অধিকর্তা সেসময় তাকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, চাইলে সপ্তাহে দুইদিন করে সে কনসাল্টেন্টের কাজ করতে পারো কিউবিতে। কিন্তু তিনি সেই অফার নিলেন না, কারণ এরকম ব্যাকআপ প্ল্যান থাকলে হয়তো তিনি কখনোই তার সর্বোচ্চটা দিতে পারবেন না নিজের প্রতিষ্ঠানে।
এভাবে ঝুঁকি নিয়েই শুরু হলো যাত্রা। ২০১৫ সালের দিকে শুরু করলেন প্রতিষ্ঠানের পূর্ণ কার্যক্রম এবং দল তৈরির প্রক্রিয়া। বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুকে সাথে নিয়ে দাঁড় করিয়ে ফেললেন তার স্বপ্নের উদ্যোগ। এই সাহসী স্বপ্নদ্রষ্টার নাম আদনান ইমতিয়াজ হালিম।
“সার্ভ উইথ লাভ”-মূলমন্ত্র নিয়ে দুই বন্ধু গড়ে তুলেছেন সেবাভিত্তিক একটি প্ল্যাটফর্ম। আদনান ইমতিয়াজ হালিম ও ইলমুল হক সজীবের গড়ে তোলা ‘সেবা ডট এক্সওয়াইজেড’ এমন একটি প্ল্যাটফর্ম, যেখানে প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় প্রায় সব সার্ভিস (সেবা) সম্পর্কিত সমস্যার সমাধান খুঁজে পাওয়া যাবে। ইলেকট্রিশিয়ান, টিভি, ফ্রিজ মেরামতের টেকনিশিয়ানের খোঁজসহ ৮৬টির বেশি সার্ভিসের খোঁজ মিলবে সেবায়। ২০১৫ সালের জুনে শুরু করলেন তাদের কাজ। ২০১৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে পদচারণা। আর দু’বছর পর প্রতিষ্ঠানটির তত্ত্বাবধানে প্রায় ১,৪০০-র বেশি কোম্পানি যুক্ত হলো। সেইসাথে বছরে ৮,০০০ চাকরি তৈরির সামর্থ্য অর্জন করে ফেললো ২বন্ধুর প্রতিষ্ঠান সেবা এক্সওয়াইজেড। জাতীয় আর আন্তর্জাতিক নানান পুরষ্কার অর্জন করে হলেন বাংলাদেশের অন্যতম সেরা স্টার্টআপ। আদনান ইমতিয়াজ হালিম দায়িত্ব পালন করছেন প্রতিষ্ঠানটির চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার এবং চেয়ারম্যান হিসেবে আছেন ইলমুল হক সঞ্জীব, যিনি একই প্রতিষ্ঠানটির চীফ অপারেটিং অফিসারের দায়িত্বও পালন করছেন, আবু নাসের শোয়েব আছেন চিফ টেকনোলজি অফিসারের দায়িত্বে আর সেইসাথে আছে সেবার বিশাল টিম।
Sheba.xyz প্রকৃতপক্ষে একটি অনলাইন সেবাভিত্তিক মার্কেটপ্লেস বা অনলাইন সার্ভিস মার্কেট। প্রতিদিন মানুষের যত ধরনের সেবা নেওয়ার দরকার হতে পারে তার প্রায় সবই পাওয়া যায় এই মার্কেটে। মোবাইল অ্যাপ এবং ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যে কেউ সেবার জন্য অর্ডার করতে পারেন এখানে। এছাড়াও তাদের রয়েছে নিজস্ব কল সেন্টার যার মাধ্যমে ফোন কলের মাধ্যমেও সেবা দিয়ে থাকে প্রতিষ্ঠানটি।
সামাজিক উদ্যোগ হিসেবে যাত্রা শুরু করা এই সার্ভিস প্লাটফর্মে বর্তমানে যুক্ত তিন হাজারের বেশি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা বাসা-বাড়ি কিংবা অফিসের জন্য বিভিন্ন সার্ভিস পৌঁছে দিচ্ছেন গ্রাহকের দোরগোড়ায়। ঘরে বসেই এখান থেকে পাওয়া যাবে ইলেকট্রনিক্স পণ্য ঠিক করা, বাসা শিফটিং, মোবাইল ল্যাপটপ সার্ভিসিং বিউটি সার্ভিস, খাবার, লন্ড্রি, পেস্ট কন্ট্রোল, গাড়ি, এমনকি চাহিদামাত্র ড্রাইভার নেওয়ার সুবিধা।
মোবাইল অ্যাপ, ওয়েবসাইট বা কলসেন্টারে অর্ডার দেওয়ার পর Sheba xyz সেই অর্ডারটি কনফার্ম করবে সেবাগ্রহীতাকে। তার বাসা বা অফিসের ঠিকানায় একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে লোক পৌঁছে যাবে সেবার পক্ষ থেকে। সমস্যা সমাধান হয়ে গেলে হাতে হাতে অথবা বিকাশ, রকেটের মাধ্যমেও বিল পরিশোধ করতে পারবেন সেবাগ্রহীতা।
২০১৬ সালে সেবার শুরু হয়েছিল শুধুমাত্র মিরপুর ডিওএইচএস এলাকায় সেবা প্রদানের মাধ্যমে। ২০১৭ সালে সেটা ছড়িয়ে গেছে সারা ঢাকায়। পুরো বাংলাদেশে সেবা দেবার লক্ষ্যে বর্তমানে কাজ করে যাচ্ছে Sheba xyz। তাদের মূল লক্ষ্য হলো, তাদের সেবাকে গোটা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া জুড়ে ছড়িয়ে দেওয়া। সেবার এই বেড়ে ওঠার গল্পের মাঝে বেশ কিছু স্বীকৃতিও পেয়েছেন তারা। পেয়েছেন জিপি এক্সিলারেটর, ইনোভেশন এক্সট্রিম এর স্বীকৃতি, একিলিওন টপ এশিয়া ১০০ পুরস্কার। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে, তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে সাধারণ মানুষদের জীবনযাত্রা সহজ করায় জাতীয় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি পুরস্কার। তবে এত এত সাফল্যের মাঝেও আদনান ইমতিয়াজ হালিমের টিম কিন্তু তাদের মূল লক্ষ্যটি ভুলে যাননি। তারা চেয়েছিল সমাজকে বদলে দিতে। Sheba xyz একটি সামাজিক উদ্যোগ হয়ে উঠবে, এটাই এখনও তাদের স্বপ্ন। আদনান ইমতিয়াজের ভাষায়, ‘আমরা আর্থিক মুনাফার চেয়ে সামাজিক জীবন মানোন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখায় গুরুত্বারোপ করছি। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার সাত, আট এবং নয় নম্বর টপিক নিয়ে কাজ করছি। সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে নতুন কর্মসুযোগ সৃষ্টি, দারিদ্র্য বিমোচন এবং কর্মের অবকাঠামো তৈরি করছি আমরা।”
পরিবর্তন হচ্ছেও বটে। অনেক শ্রমজীবী মানুষ এখন এই প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমে সঠিক মূল্যায়ন পাচ্ছেন তাদের শ্রমের। দেশজুড়ে অনেক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাকে নিজেদের তত্ত্বাবধানে এনে জীবনমানের পরিবর্তনের সুযোগ করে দিচ্ছে Sheba xyz। হাজার হাজার কর্মক্ষম মানুষকে তারা নিয়ে আসছে একটি প্রযুক্তিগত অবকাঠামোর নিচে। তাদের এই সাফল্যের পথটা যদি সামনেও উর্ধ্বগামীই থাকে, তবে তাদের হাত ধরেই আসতে পারে দেশের একটি বড় মাপের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন। আমাদের আশা, Sheba xyz থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে আরও অসংখ্য তরুণ হয়ে উঠবেন সাহসী উদ্যোক্তা, দেশে তৈরি হবে। উদ্যোক্তা নির্মাণের একটি শক্তিশালী সংস্কৃতি, বদলে যাবে বাংলাদেশ।
তথ্যসূত্র: ইন্টারনেট