Homeউদ্যোক্তা সফলতাশূন্য থেকে কোটিপতি 

শূন্য থেকে কোটিপতি 

বাংলাদেশের অন্যতম সফল ব্যবসায়ী জনাব শেখ আকিজ উদ্দিন। নামটির সাথে পরিচয় নেই এমন মানুষ বাংলাদেশে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। কীভাবে শূন্য থেকে শুধু সততা এবং নিষ্ঠার মাধ্যমে কাজ করে কোটিপতি হওয়া যায় তার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ জনাব আকিজ।

শৈশব কেটেছে কঠিন দারিদ্র্যের মধ্যে। স্বপ্ন দেখতেন দারিদ্র্য জয় করে একদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়াবেন। কিন্তু জীবনসংগ্রামের শুরুতে পদে পদে বাধার মুখে পড়েন। সেই বাধা পেরোতে শেখ আকিজ উদ্দীনের সম্বল ছিল সাহস, সততা আর কঠোর পরিশ্রম।

খুলনার ফুলতলা থানার মধ্যডাঙ্গা গ্রামে ১৯২৯ সালে জন্ম নেন শেখ আকিজ উদ্দীন। শৈশব কেটেছে কঠিন দারিদ্র্যের মধ্যে। বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান ভালো কিছু করবে এই আসায় আকিজ সাহেবের বাবা তাঁকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেও খুব বেশি দিন স্কুলে যাননি তিনি। তাই তার বাবা শেখ মফিজ উদ্দিন তাঁকে ব্যবসায় লাগিয়ে দেন। পাশাপাশি বাবার দোকানেও সময় দিতেন আকিজ। কিন্তু একদিন আকিজের বাবা তাঁকে বকাঝকা করায় রাগ করে তিনি ট্রেনে করে কলকাতা চলে যান।  তখন তার বয়স ছিল মাত্র ১১ বছর। সেখানে শিয়ালদহ রেল স্টেশনে প্ল্যাটফর্মে রাত কাটাতেন আকিজ উদ্দিন। একদিন স্টেশনের পাশে আকিজ কমলা ফল দেখে তা খুচরা বিক্রি করার চিন্তা করলেন।

মাত্র ১৬ টাকা পুঁজি নিয়ে গলায় ঝুড়ি ঝুলিয়ে কমলালেবু ফেরি করতে লাগলেন। শুরু হলো ফল বিক্রেতা আকিজের জীবনযাত্রা। ফলের ব্যবসা করে আকিজ তিন’শ রুপি জমাতে সক্ষম হন। কিছু দিন ব্যবসা করার পর তিনি একটি ভ্রাম্যমাণ দোকান দেন।

কিন্তু একদিন পুলিশ অবৈধভাবে দোকান দেওয়ার অভিযোগে তাকে ধরে নিয়ে যায়। কয়েক দিন জেল খেটে মুক্ত হয়ে আকিজ উদ্দিন উদ্ভ্রান্তের মতো কলকাতা শহর ঘুরেছেন। কলকাতায় তাঁর সঙ্গে পাকিস্তানের পেশোয়ারের এক ফল ব্যবসায়ীর পরিচয় হয়। আকিজ ওই ব্যবসায়ীর সঙ্গে পেশোয়ারে গিয়ে ফলের ব্যবসা শুরু করেন।  পেশওয়ারের ব্যবসা করে মোট ৮,০০০ টাকা মূলধন নিয়ে খুলনায় ফিরে আসেন আকিজ উদ্দিন।

 

দেশে আসার পর ব্যবসার ভূত তার মাথা থেকে কেউ সরাতে পারেনি আর। বিড়ির প্রতি তার আগ্রহ থেকে বন্ধুর বাবা বিড়ি ব্যবসায়ী বিধু ভূষণের সহযোগিতায় ১৯৫২ সালে নিজেই বিড়ি উৎপাদন শুরু করেন। পাশাপাশি তিনি গ্রামগঞ্জ ঘুরে ধান, পাট, নারিকেল ও সুপারি কিনে আড়তে আড়তে বিক্রি করেছেন। সামান্য কিছু টাকা জমিয়ে বাড়ির পাশে বেজেরডাঙ্গা রেলস্টেশনের কাছে একটি দোকানও দেন। কিন্তু দোকানটি আগুনে পুড়ে যায়। আকিজ সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েন। পরবর্তীতে তিনি এলাকাবাসীর সহায়তায় ফের দোকান দেন। শুরুতে আকিজ উদ্দিন বিড়ি বানিয়ে তার বন্ধুদের খাওয়াতেন। এভাবে তিনি বাজারে প্রচলিত বিড়ির চেয়ে ভিন্ন স্বাদের বিড়ি তৈরিতে সক্ষম হন। তিন জন শ্রমিক নিয়ে বিড়ির ব্যবসা শুরু করেন। শুরু হয় জনাব আকিজের উত্থান। তার ব্যবসায় ভালো করার অন্যতম পন্থা ছিল তিনি কম দামে ক্রেতাদের ভালো পণ্য সরবরাহ করতেন। বাজারের প্রচলিত বিড়ির দামের চেয়ে ১ টাকা কমে বিড়ি বিক্রি করতেন।

 

১৯৫৫ সালে বিড়ি উৎপাদনের জন্য সরকার থেকে অনুমোদন পেয়ে ঠিক তার একবছর পর ১৯৫৬ সাল থেকে ব্যাপক ভাবে আকিজ বিড়ি উৎপাদন শুরু করেন। পাশাপাশি তিনি মৌসুমি বিভিন্ন ব্যবসা করেন যেমন গুঁড়, পাট ইত্যাদি। জনাব আকিজের কথা ও কাজে মিল থাকা এবং তার পণ্য ভালো হওয়ায় তিনি ক্রিসেন্ট জুট মিল থেকে পাট সরবরাহের কাজ পান।

বর্তমান সময়ের মত সে সময়ও ব্যবসায়ীরা তাদের পণ্য সরবরাহ করতে মধ্যস্থতাকারি দের সাহায্য নিতেন। এই ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম ছিলেন জনাব আকিজ। তার উৎপাদিত পণ্য সরবরাহ করতে তিনি নিজে বেবি ট্যাক্সি নিয়ে খুচরা বিক্রেতাদের কাছে পণ্য পৌঁছে দিতেন।

১৯৬০ সালে তার উৎপাদিত বিড়ির চাহিদা বাড়তে থাকে। তাই তিনি খুলনায় ২০ বিঘা জমি এবং আরও ৫ টি বেবি ট্যাক্সি ক্রয় করতে সক্ষম হন। যার ফলে তিনি খুলনার পাশাপাশি তার আশেপাশের এলাকায় বিড়ির সরবরাহ শুরু করেন।

 

যুদ্ধের পর দেশে হাহাকার বেড়ে যায় এবং দ্রব্য পণের দামও বেড়ে যায় কয়েক গুণ। সেসময় আকিজ উদ্দিন তার গমজাত পণ্য বিক্রি করে প্রায় ১৫ লক্ষ টাকা লাভ করতে সক্ষম হন।

এতদিন তিনি খুলনা ও তার আশেপাশের এলাকাতে বিড়ি সরবরাহ করলেও এবার তিনি ঢাকার বাজার ধরতে চান।  তৎকালীন ঢাকার আরমানিটোলা বিড়ি ব্যবসার মূল কেন্দ্র ছিলো। জনাব আকিজ সেখানে ব্যবসায়ীদের মাঝে তার বিড়ি বিনা মূল্যে বিতরণ করলেন।ঢাকার বাজারে আকিজ বিড়ি অনেক জনপ্রিয় হলো। স্বাদেও গন্ধে ভালো হওয়ায় ধীরে ধীরে আকিজ বিড়ির জনপ্রিয়তাও বাড়তে শুরু করে।১৯৭৬ সালে রেডিওতে প্রথম প্রচারিত বিড়ির বিজ্ঞাপন ছিল আকিজ বিড়ির। এবং সে বছর তার বিড়ির উৎপাদন প্রায় ৭০ লক্ষে এসে দাঁড়ায়।

 

চামড়া ব্যবসায় তার বেশ আগ্রহ ছিল। তবে এই ক্ষেত্রে তার জ্ঞান না থাকায় তিনি তার মেজ ছেলেকে লেদার টেকনোলজি নিয়ে পড়াশোনা করতে যুক্তরাজ্যে পাঠান। এরপর জনাব আকিজ একের পর এক বিভিন্ন কোম্পানি বিক্রির নিলামে অংশগ্রহণ করেন এবং কোম্পানি গুলো ক্রয়ের মাধ্যমে তার ব্যবসা বড় করেন। নব্বই এর দশকে তিনি বিড়ি ক্রেতাদের মাঝে ম্যাচের ব্যাপক চাহিদা দেখতে পেয়ে তিনি ম্যাচের উৎপাদন শুরু করেন। তাদের উৎপাদিত ডলফিন ব্রান্ডের ম্যাচ একসময় জনপ্রিয়তার শীর্ষে ছিল। ১৯৯২ সালে তিনি দ্বিতীয় বৃহত্তম পাট রপ্তানিকারকের স্বীকৃতি পেলে সে বছরই তিনি আকিজ জুট মিল প্রতিষ্ঠা করেন।

 

জনাব আকিজের সফলতার পেছনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও রহস্য অংশ তার ‘ট্রেডমার্ক’ স্কুটার। এই স্কুটি তার জীবনের এক পরিচিত ও প্রতীকী অধ্যায়। সাদামাটা জীবনযাপন পছন্দ করা আকিজ উদ্দিন নিজেকে তার সম্পদের কেয়ারটেকার মনে করতেন। সবসময় পরিবারে একটা কৃত্রিম সংকট রাখতেন। টেক্সটাইল, সিমেন্ট, সিরামিক, খাদ্যপণ্যসসহ দেশের উল্লেখযোগ্য ২৩টি শিল্প-কারখানা প্রতিষ্ঠা করে ব্যবসার জাদুকরে পরিণত হন জনাব আকিজ। এছাড়া তিনি আদ্-দ্বীন ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠা করে স্বাস্থ্যসেবায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। প্রায় ৭০ হাজারের বেশি মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে তার প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন কোম্পানিতে।

 

বাংলাদেশের এই কিংবদন্তি মারা যান ২০০৬ সালের ১০ অক্টোবর। তিনি ছিলেন উদার মনের মানুষ। জীবদ্দশায় প্রচুর সমাজসেবামূলক কাজও করেছেন। তার হাত ধরে দেশের অনেক দরিদ্র পরিবার তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পেরেছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments