প্যানাসনিক কোম্পানি যিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন, দেশে বিদেশে লক্ষ লক্ষ কর্মসংস্থান তৈরি করেছেন, হোম-ইলেক্ট্রনিক্সে সারা দুনিয়া কাঁপিয়েছেন- তার শিক্ষাগত যোগ্যতা ছিল মাত্র চতুর্থ শ্রেণী।
মাত্র চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনার যোগ্যতা নিয়ে “কোনোসুকে মাতসুশিতা” সাহেব তৈরি করেছেন বিশ্বখ্যাত প্যানাসনিক। জাপানের সবচেয়ে বড় কনজিউমার ইলেক্ট্রনিক্স কোম্পানি। তাকে বলা হয় “দ্যা গড অব ম্যানেজমেন্ট”।
মাতসুশিতা সাহেব ধনীর ঘরে জন্ম নিলেও শিশু অবস্থাতেই পরিবারটি নিঃস্ব হয়ে যায়। চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত পড়েই পেটের দায়ে এক মৃৎশিল্প কারখানায় পেট-ভাত চুক্তিতে চাকুরি শুরু করেন। ১৬ বছর বয়সে কিশোর মাতসুশিতা ওসাকা ইলেক্ট্রিক লাইট কোম্পানিতে চাকুরি নেন। কঠোর পরিশ্রমী বালক মাতসুসিতা তার বসের নজরে পড়েন। কয়েকবছরেই কয়েক দফা প্রমোশন পেয়ে ২২ বছর বয়সে ইন্সপেক্টরের দায়িত্ব পান।
জাপানের বাড়ি ঘরে তখন মাল্টিপ্লাগের কনসেপ্ট ছিলনা। বৈদ্যুতিক তারের মাথায় ছিল একটা মুখ (সকেট)। বাতি হোক, ইস্ত্রি হোক আর (বৈদ্যুতিক হিটার) হোক, এক সঙ্গে দুটা চালানোর কোন উপায় নেই। মাতসুসিতা সাহেব চাকুরীর ফাঁকে ফাঁকে ডিজাইন করলেন একটা-সকেট। একই সাথে দুইটা এপ্লায়েন্স ব্যবহার করা গেল। গৃহকর্তৃরা খুশি হয়ে গেলেন।
তার বস এই ইনোভেশনের তেমন পাত্তা দিলেন না। প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস নিয়ে ১৯১৭ সালে চাকুরী ছেড়ে দিয়ে নিজের কোম্পানি বানালেন। পুঁজি নেই, শিক্ষাগত যোগ্যতা নেই, শুধু ম্যানুফেকচারিং অভিজ্ঞতা নিয়ে কি আর কোম্পানি চলে?
তার সকেটের কোয়ালিটি ভাল। কিন্তু প্রোডাকশন কম। নিয়মিত সাপ্লাই এর নিশ্চয়তা না থাকলে পাইকারি-বিক্রেতারা প্রডাক্ট নিতে রাজি হচ্ছেন না। কর্মচারীদের মধ্যে তার বউ আর তার শ্যালক ছাড়া সবাই ছেড়ে চলে গেল।
কোম্পানি লাল বাতিতে গিয়ে নিবু নিবু করছিল। এমন সময় এক কোম্পানি থেকে এক হাজার ইন্সুলেটর বানানোর অর্ডার পেলেন। ভাগ্য খুলে গেল। টিম বড় করলেন, সাথে সাথে সকেট বানানোর কাজ ও এগিয়ে নিলেন। হু হু করে বিক্রি হতে লাগলো মাতসুসিতার সকেট।
সকেটের পর উনি নজর দিলেন বাইসাইকেল ল্যাম্পে। ব্যাটারি লাইফ বাড়িয়ে দিলেন, উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি করলেন এক ধরনের লাইট বাল্ব দিয়ে।
হোল-সেলারদের বাইপাস করে সাইকেল দোকানদার দের কাছে সরাসরি বিক্রি করা শুরু করলেন। বিক্রি বেড়েই চললো।
হোলসেলারদের ওপর আস্থা হারিয়ে সারা দেশের জেলা শহর গুলোতে নিজে বানিয়ে নিলেন রিটেইল ইন্ডাস্ট্রি। কোম্পানি বড় হচ্ছে, আর উনি ওনার বাণী গুলোকে ও বড় করছেন। “বিজনেস ইজ পিপল” ওনার পছন্দের এক বাণী। একদিন পত্রিকাতে “ইন্টারন্যাশনাল” শব্দটা দেখে ডিকশানারি খুঁজে জানতে পারলেন “ন্যাশনাল” শব্দের অর্থ। যার সাথে “জনগণ” জড়িত। ১৯২৭ সালে “ ন্যাশনাল” ব্র্যান্ডের জন্ম হলো। ১৯২৯ সালে নতুন স্ট্রাকচার দিলেন। সারা দেশ থেকে সেলস ফোর্স রা চাহিদা পাঠিয়ে দিতেন। বিগ-ডেটা এনালাইসিস ওনারা তখনি করেছিলেন। যতটুকু চাহিদা ততটুকু প্রোডাকশন।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর আমেরিকার ম্যাক-আর্থার জাপানের ফ্যামিলি-কন্ট্রোল্ড বিজনেস গুলো ভেঙ্গে দেয়ার আইন জারি করলেন। মাতসুসিতার কোম্পানি ও সেই লিস্টে পড়লো। তাছাড়া ওনার কোম্পানি দ্বিতীয় মহযুদ্ধের সময় কিছু অস্ত্রের পার্টস বানিয়ে সাপ্লাই দিয়েছিলেন। মাতসুশিতা কে তার কোম্পানির প্রেসিডেন্ট পদ থেকে সরিয়ে দেয়াটা সময়ের দাবি ছিল।
উনি পলিসি টাকে স্টাডি করলেন। ১০০ বারের ও অধিকবার আইন প্রণয়নকারীদের সাথে মিটিং করলেন। তেমন কাজ হলোনা, তবে আইনের ফাঁক ফোকর বুঝে নিলেন।
১৫০০০ কর্মচারি একই পিটিশনে সাইন করে সরাসরি ম্যাক আর্থারের কাছে আবেদন করলেন। পাশাপাশি কোম্পানিটি কেও টুকরো টুকরো করলেন, যাতে আমেরিকার দেয়া আইনের ভেতর থেকেই কাজ চালিয়ে নেয়া যায়। মাতসুসিতা প্রেসিডেন্ট পদে বহাল রইলেন।
বাইসাইকেল ল্যাম্প প্রোডাকশনের দায়িত্ব দিলেন তার শ্যালককে। কোম্পানিটির নাম হলো Sanyo Electric. Sanyo পরবর্তিতে ব্যাটারির ওপর মনোযোগ দেয়। রিচারজেবল ব্যাটারির একচেটিয়া মার্কেট দখল করে নেয়। হোম-ইলেক্ট্রনিকস বলতে জাপানে যা বোঝায় সবই বানিয়েছেন। সঠিক সময়ে সঠিক প্রোডাক্ট টা নামিয়েছেন।
১৯৬০ সালের দিকে জাপানের মিডল ক্লাসের সামর্থ্যের কথা চিন্তা করে তিনটা প্রোডাক্ট “রেফ্রিজারেটর, ওয়াশিং মেশিন আর টেলিভিশন” একটি সেট এ করে বিক্রি করলেন।
কাস্টমার আর কর্মচারিদের সুবিধা কিভাবে ম্যাক্সিমাইজ করা যায় সে নিয়ে দিয়েছেন ১৯ টি সিদ্ধান্ত। বিজনেস যতই রিস্কে থাকুক না কেন, প্রফিট মার্জিন রাখতেন মাত্র ৩%।
৯৪ বছর বয়সে সামান্য নিউমোনিয়াতে আক্রান্ত হয়ে ১৯৮৯ সালে এই বিশ্ব ত্যাগ করেন। রেখে যান ৪২ বিলিয়ন ডলার রেভিনিউ ওয়ালা কোম্পানি।