ফেসবুক, ইউটিউব, ইন্সটাগ্রামসহ বিভিন্ন সোস্যাল মিডিয়ায় বুদ হয়ে থাকা সমাজকে বই পড়ার আমন্ত্রণ জানাচ্ছে মাইক্রো বুক কেস। যেকোনো সময় যেকেনো মুহুর্তে চাইলেই একটি বই নিয়ে পড়তে পারবেন আপনিও। লাগছে না কোনো সদস্যকার্ড কিংবা অর্থ শুধু প্রয়োজন আপনার সদিচ্ছা।
ধানমন্ডি লেকের বিভিন্ন পয়েন্টে ছোট ছোট বক্স বা কেস যা আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে বাধ্য, এ কোনো পাখির বাসা নয় – এটি একটি মাইক্রো বুক কেস।
আমাজন কিন্ডল, অ্যাপল বুকস, সেইবই, বইঘর, আলোর পাঠশালা, প্রতিলিপি, বইটই, গুডরিডস —এসব অ্যাপের ভীরে জাকিয়া রায়হানা রুপা নিলেন এক অভিনব উদ্যোগ।
ধানমন্ডি লেকের বিভিন্ন গাছে কিংবা পিলারে ঝুলে আছে পাখির বাসার মতো বই রাখার ছোট ছোট বাক্স এতে রয়েছে বিভিন্ন লেখকের বই। এমনি এক ভিন্ন উদ্যোগ নিয়ে এলেন গৃহিনী জাকিয়া রায়হানা রুপা। এই বুককেস বা বইয়ের বাক্সকে মাইক্রো লাইব্রেরি কিংবা উন্মুক্ত পাঠাগারও বলছেন অনেকে।
পৃথিবীর উন্নত অনেক দেশেই রাস্তা, বনে জঙ্গলে, নদীর ধারে এমনকি অনেকের বাড়ির সামনেও মাইক্রো বুক কেস, বুক শেলফ দেখা যায়। ওখান থেকে নিয়ে পাঠকরা বই পড়ে, পড়া হয়ে গেলে আবার রেখে দেয়। অনেকেই আবার বই ডোনেট করে। এর প্রচলন বাংলাদেশে কখনোই ছিলো না।
বই পড়ুয়া রুপার এমন একটি উদ্যোগের পিছনের গল্পটি হচ্ছে – জার্মানে বসবাসরত বাংলাদেশি মানো বিশ্বাস জার্মানির এমন একটি দৃশ্যের মনোজ্ঞ বর্ণনা নিজের ফেসবুক পেজে লিখেছিলেন। সেই দৃশ্যে মুগ্ধ হয় রুপা, নিজের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তা শেয়ার করেন।
দুদিন বাদে তাঁর মনে হলো, আমিও কেনো করছি না। ভাবলেন, বাড়ির কাছেই ধানমন্ডি লেক। সেখানে ছোট ছোট বুককেস স্থাপন করলে কেমন হয়? সকালে বা বিকেলে লেকের ধারে হাঁটতে আসা মানুষ বই পড়তে পারবেন। রুপার সবচেয়ে প্রিয় লেখক মহিউদ্দীন মোহাম্মদ। লেখকের শক্তিশালী গদ্য ও পরিষ্কারভাবে চিন্তা প্রকাশের ক্ষমতা রুপাকে আন্দোলিত করে।
রুপার ইচ্ছা ছিলো সেই লেখকের বইগুলো যদি পুরো বাংলাদেশের মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেয়া যেত তাহলে অনেক কিছু জানতে পারতো শিখতে পারতো, বুঝতে পারতো, ম্যাচিউরড হতে পারতো, ইচ্ছাটা বেশ আগে থেকেই ছিলো তার কিন্তু তখন কোনো রাস্তা খুঁজে পাননি। ফেসবুক স্ট্যাটাসটি সেই দ্বার খুলে দিলো।
১৬ নভেম্বর প্রথম বুককেসটা ধানমন্ডি ৭ নম্বর রোডের লেকের মসজিদের পেছনের রাস্তায় বসানো হলো। প্রথমটির ডিজাইন ইন্টারনেট থেকে নিলেও পরেরগুলোর নকশা করেন রুপা নিজেই। প্রথম বুককেসটি তৈরি করেছে সিমবায়োসিস আইটি নামের একটি প্রতিষ্ঠান। সেই বুককেসে ছিল রুপার প্রিয় লেখক মহিউদ্দিন মোহাম্মদের ৫টি বই। পরে হুমায়ুন আজাদ, আহমদ ছফা, শরৎচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বার্ট্রান্ড রাসেলসহ বিভিন্ন লেখকের বই বুককেসে রাখা হয়। ঝড় বৃষ্টির বিষয়টি মাথায় রেখে পিবিসির প্লাস্টিক বোর্ড দিয়ে বক্সগুলো তৈরি করছেন।
সবকিছু রুপা একা নিজ হাতে সামলাচ্ছেন। ফিজিক্যালি গিয়ে বক্স বসানো থেকে শুরু করে মিস্ত্রিকে অর্ডার দেওয়া, বই সিলেকশন করা সব কিছুই নিজে করছেন। বক্স লাগিয়ে আর বই দিয়েই ক্ষান্ত নন রুপা। প্রতিদিনই মনিটরিং করছেন সবকিছু। যারা বই পড়ছেন কথা বলছেন তাদের সাথে।
রুপা বলেন, ‘আমি প্রতিদিন লেকে যাই, লেকের পুরো পরিবেশটা আমার চেনা। কোথায় কোথায় মানুষ বসে আড্ডা দেয়, প্রতিটা পয়েন্ট আমার জানা। যখন আমি কাজটা শুরু করেছি, মনে হয়েছে আমি আমার বাড়ির পাশের লেক দিয়েই শুরু করি এবং প্রতিদিন একবার করে লেকে গিয়ে বইগুলো দেখে আসি। এগুলোকে এখন আমার সন্তানের মতো মনে হয়। অনেক মানুষের সঙ্গেই কথা হয়, সবাই অনেক সাধুবাদ জানাচ্ছে।’
শুরুটা নিজ উদ্যোগে হলেও সোস্যাল মিডিয়া বেশ আলোড়ন সৃষ্টি হয় মাইক্রো বুক কেস নিয়ে। তারপর থেকে ২য় ধাপে বুককেস বসানোর বিষয়ে সহযোগিতা চেয়ে একটি পোস্ট দিয়েছিলেন তিনি, তারপর অনেক মানুষ সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন। অনেকেই টাকা দিয়ে সহযোগিতা করেছেন। অনেকে বই পাঠাচ্ছেন। মোট ২৭ হাজার টাকা উঠেছে, নিজের বাসাসহ মোট ১৬টি বুক কেস বসানো হয়েছে।
কোন ধরনের বইকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছেন এমন প্রশ্নে রুপা বলেন, যেসব বই পড়লে মানুষ কিছু শিখতে পারবে, জানতে পারবে। সেই বইগুলোকেই সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে।
তিনি আরো বলেন,আমাদের রাষ্ট্রের যে সমাজ ব্যবস্থা সেসব বিষয়ে খুঁটিনাটি অনেক কিছু জানা প্রয়োজন। সমস্যা, সমাধানের রাস্তা নিয়ে বইগুলোকে প্রাধান্য দিচ্ছি। পরবর্তীতে এই শেখা থেকে সে যেন সমাজকে কিছু একটা দিতে পারে সেই ধরণের বই দিচ্ছি।
জাকিয়া রায়হানা রুপা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চারুকলা বিষয়ে লেখাপড়া শেষ করেন। তিনি পুরোদস্তুর গৃহিনী, বর্তমানে স্বামী ২ সন্তান নিয়ে থাকেন ধানমন্ডিতে। এছাড়াও তিনি আরো তিনটি বিষয় নিয়ে কাজ করছেন – মেন্টাল হেলথ, সেক্স এডুকেশন, প্যারেন্টিং বিষয়ে ভাবনা শেয়ার। পাঁচ ছয় বছর ধরে এই বিষয়গুলো পড়ে পড়ে শিক্ষামূলক পোস্ট দেন ফেসবুকে। এছাড়াও রাস্তার প্রাণীদের অধিকার সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করার কাজও করেন তিনি।
মানব শরীরের পুরোটা অথবা বিভিন্ন অংশ দান করা যায়। যে রোগীদের শরীরের বিভিন্ন অংশ নষ্ট হয়ে যায়, তারা দান করা এসব প্রত্যঙ্গ ব্যবহারের মাধ্যমে পুনরায় সুস্থ হয়ে উঠতে পারেন। এমন মহান কাজেই মানবিক রুপা এগিয়ে এসেছেন। ধানমন্ডির বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজে রুপা মরণোত্তর চোখ ও দেহ দান করেছেন।
রুপা বলেন, ‘মানুষের জন্য কিছু করতে পেরে আমি সুখী হই। নেওয়ার চেয়ে দিতে আমি বেশি সুখী হই। যখন যেটুকু পারি করতে চেষ্টা করি। প্রায় তিন বছর হলো এটা করেছি। এ গুণ তিনি পেয়েছেন তাঁর মায়ের কাছ থেকে। তাঁর মা ছিলেন একজন সমাজসেবক।
সেতু ইসরাত,উদ্যোক্তা বার্তা