Homeবিদেশি উদ্যোক্তানিজের শখের গাড়িটি বিক্রি করে দিয়েছিলেন টিমের বেতন, আজ কোটি টাকার ব্র্যান্ডের...

নিজের শখের গাড়িটি বিক্রি করে দিয়েছিলেন টিমের বেতন, আজ কোটি টাকার ব্র্যান্ডের মালিক

লন্ডনের এক ব্যস্ত সকাল। মেট্রো স্টেশনের কোণে দাঁড়িয়ে এক তরুণী ফোনে কাউকে ফিটনেস পরামর্শ দিচ্ছেন। কাঁধে ভারী ব্যাগ, পরনে সাধারণ পোশাক—তবে চোখে ঝলকানো আত্মবিশ্বাস। তিনি গ্রেস বেভারলি। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তখন কে জানত, একদিন এই তরুণীই হয়ে উঠবেন টেকসই ফ্যাশন দুনিয়ার অগ্রদূত!

গ্রেস মার্গারেট বেভারলি, জন্ম ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৭ সালে। শৈশব কেটেছে লন্ডনের এক শিক্ষিত পরিবারে। মা ছিলেন জাদুঘরের কিউরেটর, আর দাদা—একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। তবে গ্রেস সবসময় নিজের স্বপ্নে বিশ্বাস করতেন। ছোটবেলা থেকেই সঙ্গীত ছিল তাঁর ধ্যানজ্ঞান। সেই টানেই অক্সফোর্ডে “চোরাল স্কলারশিপ” (Choral Scholarship) নিয়ে ভর্তি হন সঙ্গীত বিভাগে।

পড়ালেখার ফাঁকে ফাঁকে ইনস্টাগ্রামে শুরু করেন ফিটনেস কনটেন্ট তৈরি—নাম দেন “GraceFitUK”। বন্ধুরা তখনো মজা করে বলত, “তুমি এটা নিয়ে সিরিয়াস নাকি?” গ্রেস শুধু হাসতেন।

এই হাসির আড়ালেই লুকিয়ে ছিল এক কঠিন সময়। অক্সফোর্ডে পড়ার সময় হঠাৎ একদিন জানানো হয়—বিশ্ববিদ্যালয় ফি দিতে না পারলে তাকে বহিষ্কার করা হবে। ঋণের চেষ্টা করেও লাভ হয়নি। সেদিন রাতে নিজের ঘরে বসে তৈরি করেন ৮ সপ্তাহের একটি ফিটনেস গাইড, PDF ফরম্যাটে। দাম মাত্র £৩৫ পাউন্ড। পরদিন সকালেই বিক্রি হয় কয়েক হাজার ডলারের গাইড। সেই টাকাতেই বাঁচে তার বিশ্ববিদ্যালয় জীবন।

এটাই ছিল গ্রেসের উদ্যোক্তা জীবনের শুরু।

ফিটনেস গাইডের চাহিদা দেখে তিনি প্ল্যান করেন একটি অ্যাপ বানাবেন, শুরুর দিকে বন্ধুদের কাছ থেকে £৫০ পাউন্ড দিয়ে লোগো ও ডিজাইন বানিয়ে নিলেন। এরপর তৈরি করেন একটি ফিটনেস অ্যাপ—’Shreddy’। এখানে পাওয়া যায় ওয়ার্কআউট রুটিন, মিল প্ল্যান, আর একটি শক্তিশালী কমিউনিটি। এটা তার প্রথম সিস্টেমেটিক উদ্যোগ—ফিটনেস শুধু শরীরের নয়, মানসিক শক্তির দিক থেকেও। সময়ের সাথে সাথে ‘Shreddy” হয়ে ওঠে ইউরোপের তরুণ প্রজন্মের পছন্দের ফিটনেস অ্যাপ।

২০১৯ সাল। বাজারে তখন একের পর এক ফাস্ট ফ্যাশনের জয়জয়কার, কিন্তু পরিবেশ ভাবনায় কেউ নেই। বিষয়টা Grace-কে ভাবালো বেশ, চিন্তা করলেন টেকসই পোশাক নিয়ে কিছু করা দরকার। প্রতিষ্ঠা করেন ‘TALA’— একটি পরিবেশবান্ধব অ্যাকটিভওয়্যার ব্র্যান্ড। যেখানে পুরনো বা পুনর্ব্যবহৃত কাপড় দিয়ে তৈরি করা হয় লেগিংস, স্পোর্টস ব্রা, জ্যাকেটসহ সব পোশাক। ব্র্যান্ডের মন্ত্র_ “স্টাইল, কিন্তু মূল্যবোধের সাথে “।

প্রথম বছরেই ‘TALA’ বিক্রি করে ৬ মিলিয়ন পাউন্ডের বেশি। কিন্তু পথটা ছিল না মসৃণ।

২০২১ সাল। গ্রেস-এর ব্যবসা নতুন বিনিয়োগকারীদের নিয়ে রি-স্ট্রাকচারিং করছিল। হঠাৎ এক মাসে পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায়—কর্মীদের বেতন দেয়ার টাকা নেই। গ্রেস নিজের ব্যক্তিগত গাড়িটি বিক্রি করে দেন, শুধু যেন তার টিমটা বাঁচে। এটা শুধু একটি গাড়ি নয়, ছিল তাঁর স্বাধীনতার প্রতীক। কিন্তু তিনি বলেছিলেন, “আমি কখনোই চাইনি আমার কর্মীরা আমার ভুলের মূল্য দিক।”

তারপর শুরু হলো পুনর্গঠনের নতুন অধ্যায়। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায় ‘TALA’।

২০২২ সালে কোম্পানি ৪.২ মিলিয়ন পাউন্ড ফান্ডিং তোলে। পরের বছর আরও ফান্ডিং আসে, টিম হয় ৮৫ জনের বেশি। আজ ‘TALA’ ইউকে ছাড়িয়ে ইউরোপ ও আমেরিকায়ও ছড়িয়ে পড়ছে।

গ্রেস এখন আর শুধু উদ্যোক্তা নন। তিনি লেখক, পডকাস্ট হোস্ট, তরুণ নারীদের অনুপ্রেরণা। তাঁর বই “Working Hard, Hardly Working” হয়েছে ব্রিটেনে সানডে টাইমস স্বীকৃত বেস্টসেলার বই। মাত্র ২৩ বছর বয়সে, ২০২০ সালে, গ্রেস বেভারলি জায়গা করে নেন ফোর্বস ইউরোপের “৩০ বছরের নিচে ৩০ জন প্রভাবশালী উদ্যোক্তা”-র তালিকায় (খুচরা ও ই-কমার্স খাত)। এরপর একে একে যুক্ত হতে থাকে সম্মাননা ও সাফল্যের পালক— ‘কানস লায়ন্স পুরস্কার’ – সৃজনশীলতা ও বৈশ্বিক ব্র্যান্ডিং জগতে এটি অন্যতম মর্যাদাসম্পন্ন পুরস্কার, যা অর্জন করেছেন তার উদ্ভাবনী নেতৃত্বের জন্য। ফোর্বস ফাউন্ডার ১০০ তালিকায় অন্তর্ভুক্তি – যেখানে স্বীকৃতি দেওয়া হয় পৃথিবীর সেরা উদ্ভাবনী চিন্তাধারার প্রতিষ্ঠাতাদের। সিম্পলি বিজনেস ইউকে-“শীর্ষ ১০০ নারী উদ্যোক্তা”- যুক্তরাজ্যের সর্বোচ্চ সম্ভাবনাময়ী নারী উদ্যোক্তাদের তালিকায় উঠে আসে তাঁর নাম। এছাড়া ‘ চার্টওয়েল স্পিকারস’– আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে নেতৃত্বদানের যোগ্যতা হিসেবে নির্বাচিত হন প্রভাবশালী বক্তা হিসেবে। এইসব স্বীকৃতি শুধু তার অর্জনের গল্প বলে না, দেখিয়ে দেয়—কীভাবে সাহস, সততা ও সামাজিক দায়বদ্ধতা নিয়েই গড়ে তুলেছেন একটি বিশ্বমানের ব্র্যান্ড।

আজ তিনি ২৮ বছর বয়সী তরুণী, যিনি তার জীবনের সবচেয়ে অন্ধকার সময়েও হার মানেননি। দেখিয়ে দিয়েছেন—সফলতা আসে সাহসী সিদ্ধান্ত থেকে, আর আত্মবিশ্বাস তৈরি হয় সংকটে লড়েই।

আজও তিনি বলেন— “আমার সফলতা এসেছে ব্যর্থতার ভয় না পেয়ে, সাহসী সিদ্ধান্ত নেওয়ার মাধ্যমে।”

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments