সইচিরো হোন্ডা, একজন জাপানি শিল্পপতি এবং প্রকৌশলী। ¬বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত এই উদ্যোক্তা Honda Automobile, Honda Motor Co., Ltd., এবং HONDA ব্র্যান্ডের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। আজ যখন রাস্তায় যেকোন ব্র্যান্ডের মোটর সাইকেল দেখলেই যে কেউ হোন্ডা বলে অবহিত করে, আসলে সেই হোন্ডা নামটি কিংবা বাইকটি যে মানুষটির মাধ্যমে পুরো বিশ্ববাসী চিনেছেন, তিনি মূলত এই সইচিরো হোন্ডা।
জাপানের ছোট্ট একটি গ্রামে ১৯০৬ সালের ১৭ই নভেম্বর সইচিরো হোন্ডা জম্মগ্রহণ করেন। তার বাবা পেশায় ছিলেন কামার আর মা ছিলেন তাতি। শৈশবে ছোট্ট সইচিরো তার বাবার সাইকেল মেরামতের কাজে সহায়তা করতেন।
মাত্র পনের বছর বয়সে তিনি বাড়ি থেকে কাজের উদ্দেশ্যে রাজধানী টোকিওর উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। টোকিওর ‘আর্টো শুকাই’ নামক একটি গাড়ি মেরামতের দোকানে সহকারী হিসেবে কর্ম জীবন শুরু করেন। পাশাপাশি গ্যারেজের মালিকের আরেকটি রেসিং কার ডিজাইনের দোকানের কাজেও সহায়তা করতে থাকেন। পরবর্তীতে ১৯২৩ সালের ভূমিকম্পে আগুন ধরে আর্টো শুকাইয়ের বিশাল ক্ষতির সম্মুখীন হয়। সেই দুর্ঘটনার সময় সইচিরো সাহসিকতার সাথে তিনটি রেসিং কার রক্ষা করতে সক্ষম হোন। এতে দোকানের মালিক তার উপর ভীষণ খুশি হোন। সেজন্য তাকে সরাসরি রেসিং কার ডিজাইনের কাজের সুযোগ করে দেন।
১৯২৪ সালে জাপান রেসিং-কার প্রতিযোগীতায় ১ম স্থান অধিকারী টিমে মেকানিক হিসাবে ছিল হোন্ডা। পরবর্তী ০৫ বছরে হোন্ডা “আর্টো শুকাই” কে টোকিওর একটি জনপ্রিয় সার্ভিস সেন্টারে পরিনত করেন। সার্ভিস সেন্টারটির বেশ কয়েকটি শাখা খোলা হয় এবং এর একটি শাখায়, প্রধান হিসাবে কাজ শুরু করেন ২১ বছর বয়সী হোন্ডা।
চাকুরীর পাশাপাশি নিজের সব জমানো টাকা খরচ করে, এমনকি স্ত্রীর গহনা বন্ধক রেখে, গাড়ীর পিষ্টন বানানো শুরু করেন। কিন্তু তার বানানো পিষ্টনগুলো তেমন ভাল হচ্ছিলো না – তিনি উপলব্ধি করলেন তার কারিগরী জ্ঞানটুকু আরো বাড়ানো দরকার। তাই তিনি এ বয়সেও একটি টেকনিক্যাল স্কুলে ভর্তি হন।
অনেক বিখ্যাত মানুষের মতোই সইচিরো হোন্ডার জীবনে সফলতা খুব দ্রুতই ধরা দেয়নি। ১৯৩৬ সালের দিকে তিনি এক কার রেসিংয়ের ময়দানে গুরুতর ভাবে আহত হোন। দুর্ঘটনায় এক হাত ভেঙ্গে, শারীরিক ভাবে ভীষণ আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে বাধ্য হোন। হাসপাতালের বেডে বসেই তিনি শুনতে পান, টয়োটা কোম্পানিতে পরীক্ষার জন্য পাঠানো তার ত্রিশ হাজার পিস্টনের মধ্যে থেকে মাত্র তিনটি কোয়ালিটি কন্ট্রোলে পাশ করেছে। এছাড়াও তখনই তার কাছে টেকনিক্যাল স্কুল থেকে অব্যাহতির নোটিশ আসে!
সইচিরো হোন্ডা হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর ১৯৩৭ সালে নিজেই ‘টোকাই সিকি’ নামে একটি কোম্পানি খুলেন। এবার তার বানানো ইউনিক পিস্টনগুলোর কোয়ালিটি অনেক বেশি ভালো। সেগুলো তিনি আবারো টয়োটা কোম্পানির কাছে সরবরাহ করতে থাকেন। কিছুদিন পরেই বাজে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু! সেইসময় হোন্ডা শুধুমাত্র টয়োটা কোম্পানিতেই প্রায় ৪০% পিস্টন সরবরাহ করতে থাকেন।
হোন্ডার সাফল্যের পথে আবারো বাঁধা আসে। ১৯৪৫ সালের বিশ্বযুদ্ধের শেষ সময়টাতে আমেরিকার বোমা বর্ষণে, তার প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়। ফলে তিনি তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানটি টয়োটা কোম্পানীর কাছে বিক্রি করে দেন মাত্র সাড়ে চার লাখ ইয়েনে। তারপর বছরখানিকের জন্য পর্দার আড়ালে চলে যান।
যুদ্ধ বিধ্বস্ত এক দেশের নাগরিক সইচিরো হোন্ডা ছিলেন অদম্য এক যোদ্ধা। এই সময় পরিবারের জন্য তিন বেলা খাবার নিশ্চিত করতেই তাকে হিমশিম খেতে হচ্ছিল! কিন্তু দু’চোখ ভরা স্বপ্ন আর এক বুক আশা তাকে সামনের পথে এগিয়ে যেতে সাহস যোগায়।
ছোট্ট গ্যারেজে বসেই তিনি স্কুটার বানাতে সফল হন। ১৯৪৬ সালে তিনি এই গ্যারেজেই প্রতিষ্ঠা করেন “হোন্ডা টেকনোলজি রিসার্স ইনষ্টিটিউট” – পরবর্তী ০২ বছরে যাকে “হোন্ডা মোটর কোম্পানী”তে রূপান্তর করেন। তিনি একটি সাধারন বাই-সাইকেলে ছোট একটি ইঞ্জিন লাগিয়ে তৈরী করেন হোন্ডার ১ম মোটর সাইকেল, যার তেলের ট্যাংকটি ছিল ছোট একটি পানির বোতল দিয়ে তৈরী।
১৭০ স্কয়ার ফিটের ছোট্ট একটি গ্যারেজে, মাত্র ১২ জন কর্মী নিয়ে Motorized Bicycle তৈরি এবং বিক্রির কাজ শুরু করেন। হোন্ডার উদ্ভাবনী শক্তি আর পরিশ্রমে বানানো ‘Choo-Choo’ নামক ১৫০০টি বাইক খুব দ্রুতই বিক্রি হয়ে যায়!
১৯৪৯ সালে হোন্ডা প্রথম পুরোপুরি নতুন ধরনের মোটরসাইকেল তৈরি করেন। এই টু-স্ট্রোক ইঞ্জিনের মোটরসাইকেল ‘ড্রিম’ নাম দিয়ে মার্কেটে ছাড়া হয়েছিল। ১৯৫৮ সালে তিনি ফোর স্ট্রোক বাইক উৎপাদন শুরু করেন এবং ‘Super Cub’ মডেলের একটি বাইক আমেরিকার বাজারে আনেন।
এরপর হোন্ডা কোম্পানি বিশ্বের প্রায় দুইশ’টি বাইক উৎপাদনকারী কোম্পানি এবং জাপানের পঞ্চাশ’টি কোম্পানির সাথে প্রতিযোগিতার করার মাধ্যমে, প্রথম সারিতে চলে আসে। ১৯৫৯ সাল থেকেই বিশ্বের শীর্ষ মোটরসাইকেল নির্মাতার মুকুটটা হোন্ডার দখলে। পরবর্তী সময়গুলোতে এই হোন্ডা কোম্পানিটি মোটর সাইকেলের পাশাপাশি গাড়ি, মেরিন মেশিনারি, জেট বিমান ইত্যাদি তৈরিতে সিদ্ধহস্ত হয়ে নিজেদের শ্রেষ্ঠতার প্রমাণ দেয়!
সইচিরো হোন্ডার একটি বিখ্যাত উক্তি হলো “যে কোন সাফল্যের ১-শতাংশ কাজ, বাকি ৯৯-শতাংশ ব্যর্থতা!” ১৯৯১ সালের ৫ই আগস্ট কিডনিজনিত জটিলতার কারণে জীবন যোদ্ধা সইচিরো হোন্ডা পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেন! অটোমোবাইল তৈরির ইতিহাসে হোন্ডা কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা সইচিরো হোন্ডা থাকবেন চির অমলিন।