বিশ্বমানের যে কোন ব্র্যান্ড, যে কোন ডিজাইন, সর্বোচ্চ নিখুঁত ও মানসম্পন্ন সু উৎপাদনে সক্ষম অবস্থানে উদ্যোক্তা নাজমা খাতুন তার কুসুমকলি সু ফ্যাক্টরিকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন । নিজেকে সফল প্রমাণ করেছেন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছেন এবং হয়েছেন দেশের মাঝারি খাতে এক প্রগতিশীল নারী উদ্যোক্তা। ২০১৯ সালে মাঝারি খাতে জাতীয় পুরষ্কারপ্রাপ্ত সেরা উদ্যোক্তা হবার গৌরব অর্জন করেন নাজমা খাতুন।
মাত্র ৫ বছরে আজ উদ্যোক্তা আন্তর্জাতিক শীর্ষস্থানীয় ব্র্যান্ড, দেশের আন্তর্জাতিক শীর্ষস্থানীয় ব্র্যান্ড এমন তিনটি ব্র্যান্ডের কাজ করছেন উদ্যোক্তার ‘কুসুমকলি সু ফ্যাক্টরি’। আজ উদ্যোক্তার ফ্যাক্টরি দক্ষ কর্মীবাহিনী প্রতিদিন দুই হাজার জোড়া জুতা তৈরী করতে সক্ষম।
তবে শুরুর গল্পটা ছিল ভিন্ন রাজশাহীর কন্যা নাজমা খাতুন চট্টগ্রামে পড়াশোনা করলেন প্যারামেডিক্স এ ডিপ্লোমা।খুব ছোটবেলায় বিয়ে হয়ে যাওয়া রাজশাহীর এই কন্যার জীবনসঙ্গী মিজানুর রহমান মিজান, জীবনের অনুপ্রেরণার বৃহৎ অংশ।
বাবা চেয়েছিলেন, মেয়ে গ্রামে গিয়ে সাধারণ সুবিধা বঞ্চিত মানুষকে সেবা দিবেন। প্রফেশন্যাল ক্যারিয়ার নিয়ে। ফার্মেসি এবং চেম্বার দিয়ে ১ বছর কাজ করা হলো। ঢাকায় ২০০০ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত চাকরি করে নাজমা।তার স্বামী মিজানুর রহমান সেই সময় সু তৈরীর একটি ফ্যাক্টরীতে কর্মরত।
নাজমা, উদ্যোক্তা হওয়াই ছিল তার ব্রত। ছোট বেলা থেকেই স্বপ্ন দেখতেন, ভিন্ন কিছু করবার। সেই দৃঢ় চেতনা, দর্শন নিয়ে নিজে কিছু করবার পথে পা বাড়ালেন নাজমা। চাকরীর পাশাপাশি ২০ হাজার টাকা সমিতি থেকে লোন নিয়ে উদ্যোগ শুরু করলেন।একটি মেশিন এবং ২ জন কর্মী। সু তৈরী করবেন নাজমা খাতুন। সম্পূর্ণ নতুন উদ্যোগে নিজেকে আবিষ্কার।
স্বামী মিজানুর রহমানের কাছে দীর্ঘদিন একটু একটু করে সু এবং সু তৈরীর ফ্যাক্টরির অনেক কিছু শুনেছেন এবং সমস্যা শোনা ও সমাধান ছোট্ট করে যেন নিজের মধ্যেই সাজিয়ে ফেলেছিলেন নাজমা।
নাজমা খাতুন উদ্যোক্তা বার্তাকে বলেন, ‘আমি হলে এমনটি করতাম ,এভাবে করলে বেটার প্রোডাকশন হবে। আমি যদি পণ্য বানাই তা অনেক যত্ন আর কোয়ালিটি নিয়ে বানাবো। এমনও হাজারও চিন্তার প্রতিফলন নিয়ে ২০০৫ সালে শুরু হলো জুতা তৈরীর কাজ।উত্তর বাড্ডায় এক হাজার চার’শ টাকা মাসে ভাড়া একটা ছোট্ট রুমে শুরু হলো দু’শো স্কয়ার ফিটে রুম হলো ফ্যাক্টরী। প্রথম দিনের কাজ থেকে একটি জেন্টস সু তৈরী করা হল। মডেলটির এক ডজন সু তৈরী হল । সহ-উদ্যোক্তা জীবনসঙ্গী মিজানুর রহমানকে টার্গেট বেধে দিলাম।আমার স্বামীও সেলস চ্যালেঞ্জ নিলেন’।
পাঠকরা জেনে আনন্দিত হবেন প্রথম ১ ডজন জুতো টার্গেট এর চাইতে বেশী লাভে এবং কম সময়ের মধ্যেই বিক্রি হয়ে গেলো। লোকাল বাজার, লোকাল দোকান। চলে বিক্রয়। ক্যাপাসিটি বাড়তে থাকলো। সেই সাথে বাড়লো প্রোডাকশন। বাড়তে থাকলো বিক্রয় পরিধি। ১৫ জন কর্মী ৪ টি মেশিন। ২ বছরের মধ্যে কর্মী সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ালো ৩০ জন।
মাত্র ৪ বছরের মধ্যে দেশের স্বনামখ্যাত সু ব্র্যান্ডের দুই হাজার জোড়া অর্ডার উদ্যোক্তাকে বলে দেয় আর ফিরে না তাকানোর কথা। আর চিন্তা না করবার কথা। দুর্দমনীয় গতিতে উদ্যোক্তা এগিয়ে যেতে থাকেন।
২০১২ সালে ৬৫ জন কর্মী এবং ৩টি স্বনামখ্যাত ব্র্যান্ড এর কাজ যখন চলতে থাকে। সেই সময় এক বিরাট ধাক্কা আসলো উদ্যোক্তার জীবনে। ফ্যাক্টরীতে অগ্নিকাণ্ড- পুরো ফ্যাক্টরি ছাই।
উদ্যোক্তা একটুও বিচলিত হলেন না। ব্যাংকে ১৭ লাখ টাকা। সেটা নিয়ে ১ সপ্তাহের মধ্যে শিরদাড়া সোজা রেখে পুন:স্থাপন করলেন ফ্যাক্টরি। পরিবারের গুরুজন চাচা একটি জমি ভাড়া দিলেন লতিফপুর গাজীপুরে। ৮ দিনের মাথায় আবারো প্রোডাকশন।
উদ্যোক্তার ধৈর্য্য, মেধা, বিচক্ষণতা দিয়ে উদ্যোক্তার ফ্যাক্টরীতে যে ক্ষয় ক্ষতি ১ কোটি ১৮ লক্ষ টাকা তা পুষিয়ে উঠলেন নাজমা মাত্র ৬ মাসেই।
তিন গুন বেশী মনোবল নিয়ে কাজ শুরু করলেন।৫০ জন কর্মী, ৫টি মেশিন। ২০১২ সাল। একের পর এক বড় বড় প্রতিষ্ঠানের, বড় বড় ফ্যাশন হাউজ, ব্র্যান্ডের অর্ডার বাড়তেই থাকলো। উদ্যোক্তা ১ বছরের মধ্যে প্রডাকশন ক্যাপাসিটি নিয়ে আনলেন প্রতিদিন পাঁচ’শ জোড়া।
মাসে প্রায় ৮০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকার কাজ বাড়ে। ৭ টি বছরে উদ্যোক্তার আজ নিয়মিত কর্মী সংখ্যা দুই’শ। উৎসবের সময় চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিতে হয়। কর্মীদের সাথে ভীষণ আপন একজন, যেন উদ্যোক্তা নাজমা খাতুন।
মাঝারি খাতে আজ উদ্যোক্তা নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আত্মপ্রত্যয়ী, গুণগতমানে ভীষণ কঠোর এবং বন্ধুসুলভ উদ্যোক্তা। কর্মী অনেক অনুসঙ্গ আজ উদ্যোক্তাকে এনে দিয়েছেন সফলতার সোনার হরিণ।
সুরাইয়া আলম