প্রতিটা দিন যার কথা মনে পরে, প্রতিটা কাজে যার কথা মনে হলে আরো উৎসাহ বেড়ে যায়,যখন কোন কষ্ট এসে মনে হানা দেয় এবং সেই সময় যার শান্তনার বানীগুলোকে স্মরণ করে মনটাকে শান্ত করি,যার স্বপ্নগুলো বাস্তবায়ন করার জন্য দিনরাত পরিশ্রম করছি সে আমার জন্মদাতা বাবা।বাবার কথা সব সময় মনে পরে কিন্ত আজ (১৫ই জুন) আমার বাবার ২য় মৃত্যুবার্ষিকী। এইদিনে আমি আমার প্রাণপ্রিয় বাবাকে হারাই।
আজ আমি উদ্যোক্তা হিসেবে যা কিছু করেছি তার শুরুটা আমার বাবার হাত ধরেই।বাবা প্রথম উদ্যোগ নিয়েছিলেন তারপর বাবার হাত ধরে আমি আমার বিজনেস এর যাত্রা শুরু করি।
মাঝে মাঝে ভাবি বাবা কত বিচক্ষণ ছিলেন। কৃষি ব্যাংকের ম্যানেজার ছিলেন বাবা।রসায়ন,পদার্থবিদ্যা,বায়োলজি কোন কিছুরই ডিগ্রীধারি ছিলেন না। তারপরও নিরবে একা একা গবেষণা করে কিভাবে রিসার্চ করে বের করে ফেললেন আদা বাটা,রসুন বাটা,পিয়াজ বাটা বাজারজাতকরন প্রক্রিয়া।
বাবা ছিলেন আমার সকল কাজের অনুপ্রেরণা। সব সময় বাবা পজিটিভ চিন্তা করতেন এবং পজিটিভ থাকতে বলতেন। বাবার ছিলো যথেষ্ট ধৈর্য্য শক্তি। কেউ কোন কষ্ট দিলে বাবা নিরব হয়ে বসে থাকতেন। কখনো তাকে প্রতিবাদ করতে দেখিনি। বাবার কাছে যখন মনে অনেক কষ্ট নিয়ে গিয়ে বলতাম “আব্বা সবার জন্য এত কাজ করি, এত কষ্ট করি তারপরও শুধু আমার ই দোষ হয়,আমারই ভুল হয় কিন্ত কেন??? কিছুক্ষণ চুপ থেকে বাবা বললেন, মা মন খারাপ করো কেন ? তুমি কাজটা করছো বলেইতো তোমার ভুল বের হচ্ছে। যে কাজ করেনি তারতো কোন ভুল নেই তাই তার কোন দোষও নেই। এভাবেই বাবা সাহস যোগাতেন, সান্ত্বনা দিতেন। আজ বাবা নেই তাই কষ্টগুলো শেয়ার করারও যায়গা নেই।
বাবার কাছ থেকে শিখেছি কিভাবে সময় মেইনটেইন করতে হয়। কোথাও যাবার প্রোগ্রাম থাকলে আগের দিন রাতের মধ্যে ব্যাগ পত্র সব গুছিয়ে বের হবার দরজার পাশে রেখে ঘুমাতে যেতেন। বাবা কোনদিন তার অফিস লেট করেন নি। বাবার কাছ থেকে আর একটা শিক্ষা পেয়েছি সেটা হোলো দোকানে বাকি না খাওয়া বা কেনা।
একবার আমার সন্তানের বাবাকে দেখেছিলেন দোকান থেকে কিছু জিনিস বাকিতে আনতে। তখনই সংগে সংগে বাবার বুদ্ধিমত্তা দিয়ে দোকান থেকে বাকি আনা হারাম করে দিয়েছে।
বাবাকে দেখিনি কখনো মিথ্যে কথা বলতে, মানুষকে ঠকানো তো দুরের কথা, কখনো এই চিন্তাও করতে দেখিনি। বাবা ছিলেন অনেক সৎ একজন মানুষ। বাবা অল্পতেই খুব খুশি হয়ে যেতেন। অপচয় একদম পছন্দ করতেন না। অল্পতেই খুশি হয়ে যেতেন। তার একটা উদাহরণ বলি-চ্যানেল আই আমাকে নিয়ে যখন ভাগ্যলক্ষী প্রোগ্রামটা করেন তখন সেখানে আমি আমার বাবার কথা বলি যে কিভাবে আমি বিজনেসে আসলাম। প্রোগ্রামটা দেখার পর আমার বাবা বললেন তার জীবন সার্থক যে আমি প্রোগ্রামে একবার হলেও তার কথা বলেছি। প্রোগ্রামটা বাবা অনেকবার দেখেছেন।
বাবা কতটা সহজ সরল মনের ছিলেন তার একটা উদাহরণ যদি বলি, কোভিডের প্রথম দিকে একবার অপু মাহফুজ ভাইয়ার সাথে ফেসবুক লাইভে একটা প্রোগ্রাম হয়। তখন বাবা আমার বাসায় ছিলেন। আমি বলাবলি করছিলাম এবং প্রোগ্রামের জন্য রেডি হচ্ছিলাম সেটা দেখে বাবানিজেও রেডি হয়ে ঘোরাঘুরি করছিলেন। তখন আমি বুঝতে পারিনি বাবা কেন রেডি হয়েছেন। প্রোগ্রাম যখন শুরু হবে তখন আমি আম্মাকে বললাম এখন কেউ যেন বেশি শব্দ না করে, প্রোগ্রাম শুরু হচ্ছে।সেটা শুনে বাবা রুম থেকে বের হয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো অপু মাহফুজ কি এসেছে?? আমি তার সাথে দেখা করবো না?? আমি বললাম না আব্বা ভাইয়াতো আসবেন না। কেন আব্বা? আব্বা তখন বললেন,ও..আমি ভাবছি অপু মাহফুজ আসবে।
আমি তখন বুঝতে পারলাম, বাবা কেন রেডি হয়ে বসে ছিলেন। তারপর আমি বাবাকে সাথে নিয়ে কিছু ছবি তুলি। এই ছবিটিই সেদিনের তোলা ছবি। আজ আমার বাবা নেই তাই আমার মানসিক শক্তি দেবার কেউ নেই।
ব্যবসায়িক কাজ শুরু করার পর (আজ থেকে প্রায় ১৭/১৮ বছর আগের কথা) থেকে বাবা যখন আমার কাছে থাকতেন তখন আমার মনে হত কখনো আমার কাছে থেকে বাবার যদি কিছু হয়ে যায় তাহলে আমি পুরা পরিবারের দায়িত্ব পালন করতে পারব তো? কারণ আমাদের ভাই নেই। অর্থাৎ আমার বোনদের সবাইকে গুছিয়ে নিয়ে বাবার দেহটা আমার মায়ের কাছে পৌছাতে পারবো তো? তবে কাজটা আমাকেই করতে হবে। কারণ আমিই আমার বাবার ছেলে। কিন্ত আমার কাছে তো কোন টাকা নেই। কিভাবে পারবো,কার কাছে চাবো। বিভিন্ন চিন্তা থেকে একটা একাউন্ট করে সেখানে অল্প অল্প করে কিছু টাকা রাখতে থাকলাম।
সৃষ্টিকর্তার কি ইচ্ছা, মা-বাবা দুজনেই আমার বাসায় ঢাকাতে বেড়াতে আসেন,তারপর করোনায় তখন আর বরিশাল যাওয়া হয়নি তাদের। হঠাৎ বাবা একদিন অসুস্থ হয়ে পড়লেন সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে যাই স্কয়ার হাসপাতালে। জানতে পারলাম বাবা স্ট্রোক করেছেন। তবে তারা ভর্তি রাখেনি ।বলেছে বাসায় রেখে চিকিৎসা চালালেও হবে। কিন্ত চিকিৎসা করানোর মতো ২৪ ঘন্টা সময় পাইনি। আগের দিন বাবা অসুস্থ হয়ে পরের দিন সকাল বেলা সবাই কে ফাঁকি দিয়ে আমাকে এতিম করে রেখে চলে গেলেন না ফেরার দেশে।
তখন কোভিডের প্রথম দিক। অনেক চ্যালেন্জ ফেইস করতে হয়েছে।এ্যাম্বুলেন্স,ডাক্তার,বাবাকে গোছল করানো। তখন করোনার জন্য সব কিছু স্বাভাবিক ছিলো না। একা একা কিভাবে যে কি করেছি নিজেও বলতে পারবো না। সব কিছু সামলাতে গিয়ে বাবাকে আর একটু ছুয়ে দেখতে পারিনি,মুখটা ভালোভাবে দেখতে পারিনি। গোসল করানোর পরে যে একেবারে ফ্রিজিং গাড়িতে তুলে ফেলবে,আমি আর ভালোভাবে দেখতে পারবো না তা বুঝতে পারিনি। তখন ছিলাম মা-বোন সবাইকে নিয়ে বরিশালের উদ্দ্যশ্যে রওনা দেওয়া নিয়ে ব্যস্ত।
শত কস্টের মাঝেও শান্তি একটাই যে, মেয়ে হয়েও বাবার ছেলে সন্তানের দায়িত্ব পালন করতে পেরেছি। বাবার দেয়া শিক্ষাগুলো জীবনে কাজে লাগানোর চেস্টা করছি। সবার কাছে আজকের এই দিনে আমি আমার বাবার জন্য দোয়া চাচ্ছি আল্লাহ্ যেন আমার বাবাকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করেন। আমিন।