নতুন প্রজন্মের সম্ভাবনাময় খাত ই-কমার্স।ইন্টারনেট যেন আরও সহজলভ্য হয়—এমন প্রত্যাশা ছিল ই-কমার্সসহ অনলাইনে ব্যবসা করা প্রতিষ্ঠানগুলোর। তাতে ব্যবসা করা যেমন সহজ হবে, তেমনি কর্মসংস্থানের নতুন দিগন্তও উন্মোচিত হবে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক চাপ, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, প্রযুক্তি ব্যবহারের সীমাবদ্ধতা, কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধিসহ নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) দীর্ঘদিন ধরেই সংকটে আছে। ই-কমার্স খাত হবে গতিশীল—এমন আশা নিয়ে ২০২৫–২৬ অর্থবছরের বাজেটে ইন্টারনেটের দাম কমানোর দাবি জানিয়েছিল উদ্যোক্তারা; কিন্তু তাদের সেই আশায় গুড়ে বালি। বাজেট প্রস্তাবে সেই প্রত্যাশার পরিবর্তে এসেছে এক নতুন চাপ।
অনলাইনে পণ্য বিক্রির কমিশনের ওপর ভ্যাট তিন গুণ বাড়িয়ে প্রস্তাবিত বাজেটে ৫ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশ করার প্রস্তাব দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ।
এতে চিন্তায় পড়েছেন এ খাতের ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা। ভ্যাট বাড়ানোর কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কায় আছেন তাঁরা। আগে ই–কমার্স ও অনলাইন প্ল্যাটফর্মে পণ্য বিক্রেতারা ৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) দিতেন। অর্থাৎ পণ্য বিক্রি করে ১০০ টাকা আয়ের ওপর ৫ টাকা ভ্যাট দিতে হতো, এখন দিতে হবে ১৫ টাকা। বাড়তি এই চাপ অনেকেই পণ্যের দামে প্রতিফলিত করবেন, যার বোঝা শেষ পর্যন্ত গিয়ে পড়বে সাধারণ ক্রেতাদের ওপর।
ই-কমার্স খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, যেসব দেশ ই-কমার্সে খাতে সফল হয়েছে, তারা মাথাপিছু ৭০ থেকে ২০০ ডলার পর্যন্ত বিনিয়োগ করেছে। বাংলাদেশে সেখানে বিনিয়োগ হয়েছে ৩ ডলারেরও কম। এখন নতুন করে আবার করের বোঝা চাপানো হয়েছে। তাদের মতে, ই-কমার্স একটি শহরের অবকাঠামো ব্যবস্থাপনার ওপর ২০ শতাংশ পর্যন্ত চাপ কমাতে পারে। চীন ও ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশ যখন ই-কমার্স খাতকে কাজে লাগাচ্ছে, তখন বাংলাদেশ যেন উলটো পথে হাঁটছে।
ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ(ই-ক্যাব) এর তথ্যমতে, দেশে অনলাইন ও ই–কমার্স খাতে বর্তমান বাজার প্রায় ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। ছোট–বড় মিলিয়ে প্রায় ৫ লাখ ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মের সাথে যুক্ত রয়েছে, যাদের বেশির ভাগেরই দোকান ভাড়া করে পণ্য বিক্রি করার সামর্থ্য নেই। তাই অনলাইনই তাদের একমাত্র ভরসা । ফলে ১০ শতাংশ বাড়তি ভ্যাট বাড়ানোর সিদ্ধান্তে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন এসব উদ্যোক্তারা।
ই-কমার্স খাতের উদ্যোক্তারা বলেন, ই–কমার্সের মাধ্যমে দেশের অ–প্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক ধারায় নিয়ে আসার সুযোগ রয়েছে, যা ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও কর আহরণের পথকে সুগম করবে। তবে ভ্যাট বাড়লে বিনিয়োগ কমবে, ফলে গ্রাহকদের জন্য বাড়তি সুবিধা ও মূল্যছাড় দেওয়ার সুযোগও সীমিত হয়ে পড়বে। ভ্যাট বাড়ালে এই বাড়তি খরচ সরাসরি পণ্যের দামে প্রভাব ফেলবে। ফলে অনলাইন কেনাকাটায় ভোক্তাদের আগ্রহ কমে যেতে পারে।
সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো(বিবিএস)এর গত বছরের অক্টোবর-ডিসেম্বর ত্রৈমাসিক জরিপের তথ্যানুসারে, দেশে এখনো অর্ধেকের বেশি পরিবার ইন্টারনেট ব্যবহার করছেন না। গত বছরের শেষ নাগাদ মাত্র ৫২ দশমিক ৪ শতাংশ পরিবার ইন্টারনেট ব্যবহার করেছে। অথচ ই-কমার্স খাতের বিকাশের জন্য সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী ইন্টারনেট জরুরি।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন ই-কমার্স খাত এখনো গড়ে উঠছে, এসময় বাড়তি কর আরোপ না করে কয়েক বছর সময় দিলে তা আরও বিস্তৃত হবার সুযোগ রয়েছে। ই-কমার্স খাতের অধিকাংশ উদ্যোক্তাই প্রান্তিক পর্যায়ের। অতিরিক্ত ভ্যাট তাদের বিপাকে ফেলবে।এতে করে সরকারের রাজস্ব বাড়ানোর যে লক্ষ্য, তাতে বরং উলটো প্রভাব পড়তে পারে। বরং যদি বিক্রির সুযোগ তৈরি করা হয়, তাহলে বিক্রি বাড়বে, আর বিক্রির সঙ্গে সঙ্গে রাজস্বও বাড়বে। তাই কমিশনের ওপর ভ্যাট জিরো পারসেন্ট করার দাবী ই-কমার্স সংশ্লিষ্টদের। তাদের মতে ভ্যাট শূন্য শতাংশ করলেও সরকার ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, বরং দীর্ঘমেয়াদে রাজস্ব বাড়বে এতে করে উদ্যোক্তাদের অংশগ্রহণমূলক প্রবৃদ্ধির পথ তৈরি হবে। এছাড়া আইএমএফ-এর শর্তানুযায়ী সংস্কারের অংশ হিসেবে বিভিন্ন করছাড় প্রত্যাহার করা হলেও সিএমএসএমইর জন্য কোনো রোডম্যাপ নেই। সুতরাং, ভ্যাট বাড়লে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে পুরো ই-কমার্স খাতেই।
তথ্যসূত্রঃ ইন্টারনেট