মোহাম্মাদ ওয়াকিফ হোসেন ২০১৭ সালে নটরডেম কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করে দেশের বাইরে পড়তে যান। ফিনল্যান্ডে আড়াই বছরের মাথায় গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে বিভিন্ন কোম্পানির সাথে কাজ করেন। ২০২০ সালে তিনি মাস্টার্স শুরু করেন, পাশাপাশি একটি আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) কোম্পানিতে যোগ দেন সার্বক্ষণিক কর্মী হিসেবে। ফিনল্যান্ডের রাজধানী হেলসিংকিতে ওই প্রতিষ্ঠানটির নাম ইউটোপিয়া এনালিটিক্স।
কিন্তু, ঢাকায় বেড়ে ওঠা ওয়াকিফ উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন ছোট থেকেই। পরিবারের সকলে বলতেন, এসব চিন্তা বাদ দিয়ে ভালোমতো পড়াশোনা করতে হবে। সেটা তিনি করতেন, তবে লেখাপড়ার পাশাপাশি কোনো না কোনো উদ্যোগ যেটাকে স্টার্টআপ বলা যায়– তাতেও মন পড়ে ছিল তার। যেকোনো পণ্য বেচাকেনাতে আগ্রহী ছিলেন তিনি। মানুষকে বুঝতে ও জানতে ভালোবাসেন এবং কাস্টমার রিলেশনশিপ ম্যানেজমেন্টেও আগ্রহ ছিলো খুব।
২০১৫ সালে কলেজ জীবনের প্রথম বছরেই কয়েকজন বন্ধুসহ একটি আর্টওয়ার্ক শেয়ারিং ওয়েবসাইট শুরু করেন ওয়াকিফ। এর নাম ছিল অ্যাবস্ট্রাক্ট মার্ট। যে কোনো আর্টিস্ট তার ডিজিটাল আর্ট অথবা হাতে আঁকা শিল্পকর্ম তাদের ওয়েবসাইটে আপলোড করতে পারতেন। অনেকটা ইনস্টাগ্রাম-এর মতোই ছিল অ্যাবস্ট্রাক্ট মার্ট, তবে তাদের বিশেষত্ব ছিল যে তারা শিল্পকর্মটির গুণগত মান একটুও নষ্ট হতে দিতেন না।
সে ধারাবাহিকতায় ওয়াকিফ আজ Greylo এর মাধ্যমে পুরোদস্তুর উদ্যোক্তা।
Greylo-এর আইডিয়াটাও শুরু হয় কলেজ জীবনে। অ্যাবস্ট্রাক্ট মার্ট শুরু করার পর তিনি ভাবলেন, সকল আর্টিস্টের জন্য একটা কর্মক্ষেত্র আর তাদের প্রিয় কাজ কোনো একটা পণ্যে রূপ দিতে পারলে ভালো হতো। তারা যেসব জুতা পরতেন সেগুলো দেখে ওয়াকিফের মনে হলো, এ জুতার ডিজাইন এমন না হয়ে অন্যরকম হলে কেমন হতো! অথবা এই জুতার উপরেই যদি নিজের মন মতো ডিজাইন করা যেতো!
এ নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে অনেক আলোচনা করতেন তিনি। সবসময় ভাবতেন এমন একটা প্রোডাক্ট বের করবেন যেখানে মানুষ যেরকম ইচ্ছা, তার মন মতো সেরকম জুতা বানিয়ে পরতে পারবেন। কিন্তু সেটা তাদের কলেজ জীবনে শুধুমাত্র একটা আইডিয়া ছিল। এ নিয়ে তেমন কাজ আর করা হয়ে উঠেনি, কারণ সেটা ছিল ছোট বয়সের একটা ভাবনা।
ছোট বয়সের সেই ভাবনাই আজ বাস্তব হয়েছে।
পনেরা হাজার টাকা পুঁজি দিয়ে যাত্রা শুরু। তারা আস্তে ধীরে মাইক্রো ফাইন্যান্সিং শুরু করেন, কখনোই ম্যাক্রো ফাইন্যান্সিং-এ যাননি। মানে একসাথে অনেক টাকার প্রোডাক্ট এনে বিক্রি করেননি তারা। বরং ছোট ছোট করে প্রতিবার ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করে জুতা আর পেইন্টস আনেন। ২০২০ সাল পুরোটাই ছিল পরীক্ষামূলক। ২০২১ থেকে উদ্যোক্তা হিসেবে বিক্রি শুরু করেন।
উদ্যোক্তা হিসেবে যখন জুতা বিক্রি শুরু করেন , তখন তাদের শোরুম না থাকায় একটা ঝামেলা হয়। কারণ কাস্টমাররা স্বভাবতই দোকানে গিয়ে জুতা কেনেন অথবা অনেকবার ট্রায়াল দেয়ার পরে জুতা কেনেন। অনেকেই জানেন না যে কীভাবে বাসায় নিজের জুতা মাপা যায়। এ সমস্যা দূর করার জন্য বেস্ট কাস্টমার সার্ভিসকে ওয়াকিফ এবং তার বন্ধুরা বিকল্প হিসেবে বেছে নেন। সেটা কী হবে, ভাবতে থাকেন তারা। সমাধান হয় এভাবে: প্রথম কথা যে সকলে জুতা পাওয়ার পরে দাম দেবেন। দ্বিতীয়ত তারা সাইজে না মিললে ফ্রি রিটার্ন নিশ্চিত করেন।
উদ্যোক্তার কর্মী আপাতত সাতজন। পণ্যের দিক থেকে তিনি দু’ ধরনের জুতা বিক্রি করেন। ভবিষ্যতে প্রোডাক্ট লাইন আরো বাড়াবেন বলে জানান ওয়াকিফ।
এ ব্যবসায় ঢুকে তিনি কাস্টমারদের কাছ থেকে নানারকম ফিডব্যাক পেয়েছেন। তার একটি জুতার ফিতা। অনেকেই অন্য রঙের ফিতা চান। তাই বিভিন্ন রঙের ফিতা নিয়েও তারা কাজ শুরু করেন।
আপাতত তাদের শুধু অনলাইন শপ রয়েছে। তবে, খুব তাড়াতাড়ি শোরুম নেবেন তারা। বাংলাদেশের সকল জেলা থেকেই অর্ডার করা সম্ভব এবং এরইমধ্যে অনেক জেলায় তারা পণ্য সরবরাহও করেছেন। জুতার দাম বাংলাদেশি টাকায় ২ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকার মধ্যে। প্রতি মাসে গড়ে ১০ থেকে ১৫ জোড়া জুতা বিক্রি করেন তিনি।
‘GreyLo’ নিয়ে পরিকল্পনা
এখন শুধু জুতা নিয়ে কাজ করলেও ভবিষ্যতে তিনি সকল কাস্টোমাইজড পণ্যের জন্য একটা মার্কেটপ্লেস তৈরি করতে চান। সেখানে উদ্যোক্তারা তাদের কাস্টোমাইজড ব্যাগ, ঘড়ি, জামা ইত্যাদি ক্রয় ও বিক্রয় করতে পারবেন। তাদের মার্কেটপ্লেসে শুধু তারাই পণ্য বিক্রি করবেন না, অন্য উদ্যোক্তারাও তাদের উদ্যোগ নিয়ে তাদের পণ্য মার্কেটপ্লেসে বিক্রি করতে পারবেন।
ওয়াকিফ মনে করেন, এর মাধ্যমে বাংলাদেশে আর্ট এবং শিল্পজগতে একটা বিপ্লব হবে যেখানে অনেক আর্টিস্ট তাদের প্রিয় কাজ দিয়ে জীবিকা অর্জন করতে পারবেন।
উদ্যোক্তা বার্তার সাথে একান্ত আলাপচারিতায় ওয়াকিফ বলেন: আমি যখন প্রথম ২০১৭ সালে ফিনল্যান্ডে আসি, তখন আমাকে সকলে উপদেশ দেয় যে, তুমি ব্যবসা করে কী করবে? ফিনল্যান্ডে বিদেশিদের জন্য শুধুমাত্র ইঞ্জিনিয়ার হলেই জব আছে, আর তুমি তো এ দেশের ভাষাও জানো না। তাই তুমি ইঞ্জিনিয়ারিং-এ শিফট করো। তারপরও আমি ইঞ্জিনিয়ারিং-এ শিফট করিনি, কারণ আমি আমার উদ্যোগ নিয়েই গর্ববোধ করি। আমার যেটা ভালো লাগে ওটা নিয়ে আমি কাজ করতে রাজি আছি। তবে যেটা আমার ভালো লাগে না ওখানে অনেক টাকা থাকলেও ওই কাজের প্রতি আমার ভালোবাসা থাকবে না।
তিনি বলেন: আপনার স্বপ্ন অনেক আলাদা, অনেক সুন্দর অথবা অনেক বড় হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। বরং আপনার স্বপ্নটা ছোট হলেও সেটা আপনার নিজের হওয়াটা অনেক জরুরী’।
মাসুমা সুমি,
উদ্যোক্তা বার্তা