পোল্ট্রিখাতে ইয়াসমিন রহমানের স্বপ্নজয়

0
উদ্যোক্তা বার্তা

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রাণী সম্পদ খাতের উপখাত হিসাবে পোল্ট্রি শিল্প একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। এটি যে একটি স্বতন্ত্র অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে তা অস্বীকার করার উপায় নেই। কারণ ডিম এবং মাংস সরবরাহের মাধ্যমে দেশের প্রোটিন-ঘাটতি পূরণে পোল্ট্রি খাতে দেশীয় পুঁজি এবং উদ্যোগে তিলে তিলে গড়ে উঠেছে এই শিল্পটি।

পোল্ট্রি ব্যাপকভিত্তিক কর্মসংস্থানমুখী একটি সমৃদ্ধ শিল্প। বিশেষত আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্রে বাংলাদেশে এই শিল্প নতুন বিপ্লবের পথ দেখিয়েছে প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ৬০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে এ-শিল্পে। পোল্ট্রি শিল্পের বর্তমান এ-অবস্থান উদ্যোক্তা, খামারি, সরকার, বিভিন্ন এনজিও এবং কৃষি বিজ্ঞানী ও উদ্যোক্তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল। যাদের প্রানান্ত প্রয়াসে পোল্ট্রি শিল্পের উন্নতি ঘটেছে তাদের মধ্যে প্যারাগন গ্রুপের নাম আসে সবার প্রথমে।

ইয়াসমিন রহমান প্যারাগন গ্রুপের পরিচালক। তার জন্ম ঢাকায়। বাবা পেশায় ব্যবসায়ী। মা ডাক্তার। তৎকালীন মিডফোর্ড মেডিকেল কলেজ থেকে গাইনি বিষয়ে পাশ করে ঢাকার ন্যাশনাল হসপিটালে প্রাক্টিস করতেন। ওখানেই তিনি কর্মজীবন শেষ করেন।

ইয়াসমিন রহমান ঢাকার সেন্ট ফ্রান্সেস গার্লস স্কুলে শিক্ষাজীবন শুরু করেন এবং কামরুন্নেছা গার্লস স্কুলে স্কুল জীবন শেষ করেন। ১৯৮৬ সালে গার্হস্থ্য অর্থনীতি বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন এবং একই বছর প্যারাগন গ্রুপের বর্তমান এমডি মশিউর রহমানের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এরপর বাবা-মা, শ্বশুর-শ্বাশুড়ি ও স্বামীর অনুপ্রেরণায় একই বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। পড়াশোনা শেষে ১৯৯১ সালে স্বামীর উদ্যোগে ব্যবসা জীবনের সাথে জড়িত হন। এক আত্নীয়ের মাধ্যমে শোনেন পোল্ট্রি শিল্পের সম্ভাবনার কথা। শিক্ষাজীবনে পোল্ট্রি বিষয়ে জানার আগ্রহ থেকে পোল্ট্রি বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।

প্রথমে ৫০০-১০০০ লেয়ার মুরগির বাচ্চা নিয়ে বাড়িতে পরীক্ষামূলক ভাবে একটা খামার শুরু করেন। তাতে সফলতা পেলে ১৯৯৩ সালে ইয়াসমিন রহমান ও তার স্বামী মশিউর রহমান গাজীপুরের বানিয়ারচালায় গড়ে তোলেন ২৫ হাজার লেয়ার মুরগীর খামার। শুক্র, শনি কিংবা বন্ধের দিন নেই, চলে যেতেন ফার্মে। মুরগীকে খাওয়ানো থেকে শুরু করে অনেক কিছুই করতেন নিজ হাতে। ছেলে-মেয়েদেরকেও সঙ্গে করে ফার্মে নিয়ে যেতেন।

প্রথমদিকে ভারতীয় বাচ্চা দিয়ে খামার করায় কিছু অসুবিধা দেখা দেওয়ায় কানাডা থেকে বিমানে করে ১০ হাজার একদিনের সেভার বার্ড বাচ্চা আনেন। প্যারাগন গ্রুপই বাংলাদেশে প্রথম মুরগির বাচ্চার স্বাস্থ্য সুরক্ষায় এনভায়রনমেন্ট কন্ট্রোল হাউজের মাধ্যমে টানেল ভেন্টিলেশন ব্যবস্থা শুরু করেন। গড়ে তুলেছেন গ্রান্ড প্যারেন্ট স্টক (জিপি) ফার্ম। বছরে চার বার বিদেশ থেকে বাচ্চা আসে। গ্রান্ড প্যারেন্ট স্টক ছাড়াও তাদের আছে – প্যারেন্ট স্টক (পিএস), কমার্শিয়াল লেয়ার, কমার্শিয়াল ব্রয়লার, সোনালি, প্যারাগন কালার বার্ড, ফিস, ফিস ফিড, ও ফিস হ্যাচারি। প্যারাগন গ্রুপের বর্তমান ব্রিডার ফার্ম ১২টা ও হ্যাচারি ১১টা। বর্তমানে মাসে প্রায় ১ কোটি ব্রয়লার ও লেয়ার প্যারেন্ট স্টক (পিএস), কমার্শিয়াল লেয়ার, কমার্শিয়াল ব্রয়লার, সোনালি, প্যারাগন কালার বার্ড – এক দিনের বাচ্চা উৎপাদন করে। এছাড়া দিনে প্রায় ৭ লক্ষ ডিম এবং এক ব্যাচে প্রায় ৮-৯ লক্ষ কেজি মুরগির মাংস উৎপাদন করেন।

ব্যাবসার শুরুতে ফিড হাতে বানাতে হতো যাতে সময় এবং শ্রম দুই-ই লাগতো বেশি। সে জন্য তারা জার্মানি বুলার মেশিন দিয়ে একটি ফিড মিল স্থাপন করে ফিড উৎপাদন শুরু করেন ৷ এখন তাদের ফিড মিলের সংখ্যা ৭ টি। পোল্ট্রি, মাছ ও অন্যান্য পশু খাদ্য উৎপাদন হয় মাসে প্রায় ৪০ হাজার টন।

পরিবেশ সংরক্ষণ ও আধুনিক প্রযুক্তির কথা মাথায় রেখে পোল্ট্রি ও অন্যান্য বর্জ্যকে কাজে লাগিয়ে গড়ে তুলেছেন বায়ো এনার্জি প্রজেক্ট। উৎপাদিত হচ্ছে জৈব সার, বায়ো গ্যাস এবং বিদ্যুৎ। বর্তমানে তার কোম্পানিতে কাজ করছেন প্রায় ৭ হাজার কর্মী। পরোক্ষভাবে জড়িত আছেন আরো প্রায় ৩০ হাজার কর্মী। এছাড়াও নিজস্ব এবং যৌথ উদ্যোগে রয়েছে প্রেস, হিমায়িত খাদ্য, প্লাস্টিক, চা বাগান, ইন্স্যুরেন্স, টেক্সটাইল, স্পিনিং, প্রাইভেট ইকোনমিক জোন, আন্তর্জাতিক মানের স্কুল এবং পরিবেশ বান্ধব সোলার প্যানেল এবং সোলার বিদুৎ উৎপাদন ব্যবসা। ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড ছাড়াও তিনি বহু সামাজিক ও সাংগাঠনিক কাজের সাথে জড়িত আছেন। সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে যুক্ত হয়েছেন বিভিন্ন সামাজিক উন্নয়ন সংস্থার সাথে যা দেশের শিক্ষা ও নারী উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে।

সাইদ হাফিজ
উদ্যোক্তা বার্তা, খুলনা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here