উদ্যোক্তা- মাহমুদা খাতুন

মাহমুদা খাতুনের গল্প শুনলে সাধারন একজন নারীর জীবন-যুদ্ধের সম্পর্কে জানা যায়। যিনি কঠোর পরিশ্রম ও অধ্যবসায় এর মাধ্যমে নিজের জীবনের মোড় ঘুড়িয়ে দিয়েছেন এবং নিজেকে একজন স্বনির্ভর ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। রাজধানী ঢাকা শহরের মত স্থানে মাহমুদা নিজেকে প্রশিক্ষণ এবং সেলাই ও হস্তশিল্প ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার পাশাপাশি সমাজের অসহায় নারী পুরুষদের কর্মসংস্থানে সহযোগীতা করে যাচ্ছেন।

কলা এবং মানবিক বিভাগ থেকে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করার পর মাহমুদার কলেজ জীবন থেকে হস্তশিল্প সংক্রান্ত বিভিন্ন ধরণের প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতামূলক প্রশিক্ষণের প্রতি আগ্রহ ছিলো।

শিক্ষা জীবন শেষ করে কাজে যোগদান করলেও বিয়ের পর যখন তিনি মা হলেন তখন স্বামীর আপত্তির কারণে তাকে চাকরি ছেড়ে দিতে হয়। সংসারের মাসিক আয় ১৮ হাজার টাকা হওয়ার পরও নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রে মূল্যের ক্রমবর্ধমান উর্ধ্বগতি দেখে মাহমুদা নতুন করে কিছু একটা করার প্রয়োজন অনুভব করেন।

জীবনের শুরুতে প্রশিক্ষণের হাতে খড়ি হয় যুব উন্নয়নে। প্রথম প্রথম ঘরে বসেই প্রতিবেশীদের টুকটাক সেলাইয়ের কাজ করে অর্থ উপার্জন শুরু করেন। কিন্তু প্রতিবেশীদের কাছ থেকে দিনদিন কাজের বাড়ন্ত অনুরোধ তাকে নিজস্ব ব্যবসা প্রতিষ্ঠার ব্যপারে আত্মবিশ্বাসী করে তোলে।

এ পর্যায়ে ১৯৯৯ সালের দিকে তিনি ঘরে বসেই বাড়ির আশেপাশের মহিলাদের অর্থের বিনিময়ে ব্লক-বাটিক, প্রিণ্টিং ও সেলাইয়ের কাজের প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেন। প্রশিক্ষণার্থীদের সংখ্যা দিনদিন বাড়তে থাকলে তিনি বাসায় একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করতে চাইলেন কিন্তু আবারও তার স্বামীর আপত্তির কারণে তা সম্ভব হয়নি।

মাহমুদা স্বপ্নকে সত্য করার সংকল্প থেকে সরে যাননি। মিরপুরের কাফরুলে একটি ঘর ভাড়া করে তার ছোট্ট একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করেন। তার মনে হয় সেই দিন বেশী দূরে নয়, যেদিন মানুষ এই ধরণের দক্ষতামূলক প্রশিক্ষণে অংশ নিয়ে সহজ কর্মসংস্থানে আগ্রহী হবে।

যদিও ব্যবসা পরিচালনার জন্য তার পেশাদারী কোন যোগ্যতা বা অভিজ্ঞতা ছিলো না। তারপরেও নিজের কঠোর পরিশ্রম করার ক্ষমতা ও একাগ্রতার উপর ভরসা করে মাহমুদা তার স্বপ্ন থেকে বিচ্যুত হননি।

২০১২ সালের দিকে মাহমুদা তার স্বপ্ন পূরণের পথে একধাপ এগিয়ে যান। যখন তিনি দক্ষতা উন্নয়নমূলক প্রশিক্ষণের প্রদান তথা প্রশিক্ষণ ব্যবসা পরিচালনার জন্য চুক্তিবদ্ধ হন স্কিল ফুল এর সাথে। স্কিল ফুল এর সহযোগী হিসেবে চুক্তির পূর্বে মাহমুদার প্রতিষ্ঠানের প্রশিক্ষণার্থীদের ভালোভাবে জায়গা হত না। যে ঘরটি তিনি ভাড়া নিয়েছিলেন সেই ছোট্ট ঘরেই চলতো প্রশিক্ষণের ক্লাস এবং তিনি নিজেই ছিলেন একমাত্র প্রশিক্ষক। চুক্তি হওয়ার সাথে সাথে এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটির চেহারা আমূল পরিবর্তন হয়।

মাহমুদা তার শতাব্দী ফ্যাশন ডিজাইন নামের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটির জন্য ৫ কক্ষের একটি বাসা ভাড়া করেন। যেখানে ৪টি কক্ষে প্রশিক্ষণ এবং একটি কক্ষে অফিস পরিচালনা করতে শুরু করেন। তার এই প্রতিষ্ঠানে ৮ জন প্রশিক্ষক নিয়োগ প্রাপ্ত আছেন যারা কারচুপি, ব্লক, বাটিক প্রিণ্টিং, ইলেক্ট্রিক্যাল হাউজ ওয়্যারিং, রেফ্রিজারেশন ও এয়ারকন্ডিশনিং এবং দর্জি পেশার প্রশিক্ষণ দেন।

প্রশিক্ষকদের প্রত্যেকে মৌলিক প্রশিক্ষণ পদ্ধতি বিষয়ক প্রশিক্ষণে অংশ নিয়েছেন। এ পর্যন্ত মোট ১১৭০ জন যুব, পুরুষ, মহিলাকে নানান পেশায় এই প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে।

মাহমুদা মনে করেন, এই সকল প্রশিক্ষণ প্রাপ্তদের মধ্যে এক হাজার ২১ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করায় হলো তার প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে বড় অর্জন।
নানা বিষয়ে নানান ট্রেনিং, বিভিন্ন সক্ষমতা উন্নয়ন বিষয়ক প্রশিক্ষণ, সেমিনার কর্মশালা, তার ব্যবসায়িক ও প্রশাসনিক দক্ষতাকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে বলে মনে করেন উদ্যোক্তা মাহমুদা খাতুন। চুক্তি অনুযায়ী তিনি নিয়মিত ভাবে প্রকল্পকে নানা ধরণের প্রয়োজনীয় তথ্য প্রদান করতেন যা তাকে প্রশিক্ষণার্থী, প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত যুব-পুরুষ, মহিলা, চাকরিদাতা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয় তথ্য নথীকরণ, সংরক্ষণ ও সেই সাথে অন্যান্য হিসাব রক্ষণ বিষয়ে প্রশাসনিক কাজকে সহজ করেছে।

ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য সম্প্রতি তিনি একটি ব্যাংকে ঋণ আবেদন করেন এবং সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যপার হলো মাহমুদার ব্যবসার প্রসার দেখে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তাকে তার আবেদনকৃত অর্থের আর্থিক পরিমান ঋণ প্রদান করেন। তার প্রতিষ্ঠান থেকে যেসকল কারচুপি, ব্লক, বাটিক ও সেলাইয়ের পোশাক, হস্তশিল্পজাত পণ্য তৈরি হয় তা স্থানীয় চাহিদা পূরণ করে অস্ট্রেলিয়া ও জাপানে বসবাসরত বাঙ্গালীদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। তিনি বাংলাদেশ মহিলা চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ এর একজন সদস্য।

 

মাহমুদা স্বপ্ন দেখেন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র অনেক বড় করবার। দরিদ্র, কর্মহীন যুব-পুরুষ ও মহিলাদের প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে তার মত উদ্যোক্তাকে টেকসই ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তথা সাফল্য অর্জনে সার্বিকভাবে এগিয়ে যাওয়াকে জীবনের প্রধান সাফল্য বলে মনে করেন সফল উদ্যোক্তা মাহমুদা খাতুন। মাহমুদা খাতুনের মত যারা দক্ষতা উন্নয়নমূলক এই প্রশিক্ষণের মর্ম বুঝতে পারবেন তারাই সহজে জীবনে সফল হতে পারবেন বলে মাহমুদার দৃঢ় বিশ্বাস।

 

 

ডেস্ক রিপোর্ট, উদ্যোক্তা বার্তা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here