স্বপ্নের চেয়ে বড় মানুষ বর্ণা

0

কে বেশি বড়? মানুষ না তার স্বপ্ন? মানুষ চাইলেই তার স্বপ্নের চেয়েও বড় হতে পারে। কিন্তু শুধু স্বপ্ন দেখেলেই যেমন স্বপ্নের নাগাল পাওয়া যায় না তেমনি স্বপ্ন পূরণে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হলে কোনো কিছুই তার পথ আটকাতে পারে না। উদ্যোক্তা বর্ণা আসলামের ক্ষেত্রেও তার ব্যাতিক্রম ঘটেনি। মাত্র ১৫ বছর বয়সে বিয়ে নামক রাহু তার স্বপ্নকে গ্রাস করতে চাইলেও প্রবল প্রাণশক্তির জোরে তিনি নক্ষত্রের মতো জ্বলে উঠেছেন একজন সফল উদ্যোক্তা হয়ে।

২০০৮ সালে কল্যাণপুর গার্লস স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে পড়াকালে তার বিয়ে হয়। শ্বশুর বাড়ির লোকজন বিয়ের পর তাকে পড়াশোনার সুযোগ দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু বিয়ের পর তারা তাকে পড়াশোনা করতে নিরুৎসাহিত করেন। বর্না এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি। তার ভাইবোনরা সবাই শিক্ষিত। এমনকি তার শ্বশুর বাড়ির লোকজনও কমবেশি শিক্ষিত। তাই তার মধ্যে জেদ চেপে যায়। পড়াশোনা তিনি করবেনই। তার নিজের বাড়ি ও শ্বশুর বাড়ির লোকজনরা তাকে নিবৃত করতে পড়াশোনার কোনো খরচ দেবেন না বলে সাফ জানিয়ে দেন। পাঠক, কি ভাবছেন, তবে কি বর্ণার পড়াশোনায় এখানেই পূর্ণছেদ পড়ে গেলো?

বর্ণা দমে যাওয়ার পাত্রী ছিলেন না। বর্ণা পড়তে চাইতেন। জীবনে অনেক বড় কিছু করার স্বপ্ন ছিলো তার। সবার অনিচ্ছা সত্ত্বেও তিনি পড়াশোনা চালিয়ে গেলেন। কিন্তু পড়াশোনার খরচ? তার কী হবে? তিনি তখন সবে মাত্র সপ্তম শ্রেণীতে পড়েন। রাস্তা ঘাট তেমন কিছুই চেনেন না। একদিন ছোট্ট বর্ণা টিফিনের টাকা জমিয়ে নেমে পড়লেন জীবনের বড় রাস্তায়। নিউমার্কেটে গিয়ে ব্লক-বাটিকের কিছু ড্রেস কিনে আনলেন। স্কুলের সহপাঠী ও শিক্ষকদের কাছে সেগুলো বিক্রি করা শুরু করলেন। সেদিন কেউ তাকে দেখে হাসলেন, কেউ কেউ টিপ্পনীও কাটলেন। কিন্তু তাতে তার কিছুই এসে গেলো না। সেসময় সবাই নিরুৎসাহিত করলেও তার মা এবং ছোট বোনের শিক্ষক তাকে খুব উৎসাহ যুগিয়েছিলেন। নিজের পড়াশোনার খরচ নিজেই চালাতে লাগলেন। প্রাণান্তকর চেষ্টায় কল্যাণপুর গার্লস স্কুল থেকে এসএসসি ও মোহাম্মদপুর সরকারি মহিলা কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করলেন লড়াকু বর্ণা আসলাম। উদ্যোক্তা বার্তার সাথে এক দীর্ঘ আলাপচারিতায় তিনি বলেন,” বর্তমানে আমি উত্তরা ইউনিভার্সিটিতে গ্রাজুয়েশন প্রোগ্রামে ভর্তি হয়েছি। আমার শ্বাশুড়ি আমাকে বলেন, ‘আমাদেরতো আল্লাহ দিলে অবস্থান খারাপ না। তোমার আর পড়াশোনার দরকার নেই। তুমি এখন মা হয়েছো। নিজে না পড়ে বাড়িতে বসে মেয়েকে পড়াও’। কিন্তু আমি পোস্ট গ্রাজুয়েশনটাও শেষ করতে চাই। আমার আশেপাশে সবাই শিক্ষিত। আমি কেনো পিছিয়ে থাকবো?”

খুব ছোটবেলা থেকেই ফ্যাশন ডিজাইন ও ড্রয়িং-এর প্রতি অনুরাগ ছিলো উদ্যোক্তা বর্ণার। যেখানে যা দেখতেন তাই যেনো দুচোখের ক্যামেরায় বন্দি করে নিতেন। নিমেষেই রপ্ত করে ফেলতেন ডিজাইনের বিভিন্ন ধরণের করণ-কৌশল। কলেজ জীবনে জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষিকার মেয়েকে পড়াতেন তিনি। পড়াশোনা আর টিউশনির পাশাপাশি সেলাই মেশিনের কাজও শেখেন সেসময়। এটা জেনে সেই শিক্ষিকা মেয়েকে পড়ানোর পাশাপাশি নিজের বিভিন্ন রকমের পোশাক তৈরির কাজ দিতেন। শিক্ষিকার দেওয়া ডিজাইনগুলো ছিলো ইউনিক। সেগুলো করতে গিয়ে প্রচুর শেখার সুযোগ হয়েছে তার। এরপর জাতীয় মহিলা সংস্থা ও বিসিকে ফ্যাশন ডিজাইনের উপর প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। তাছাড়া ব্যক্তিগত ভাবে অনেক গুণী প্রশিক্ষকের কাছে কাজ শিখেছেন। কোথাও চাকরি করার তেমন কোনো অভিজ্ঞতা নেই তার। তবে বর্তমানে জাতীয় মহিলা সংস্থার অধীনে ‘তৃণমূল পর্যায়ে অর্থনৈতিক নারী উন্নয়ন বিকাশ সাধন’ প্রকল্পের ফ্যাশন ডিজাইনিং বিষয়ের প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

ছাত্রজীবনে পণ্য বিক্রি, টিউশনি ও সেলাইয়ের কাজ করে জমানো ২০০০ টাকা দিয়ে ৬ পিস থ্রিপিস কিনে ২০১৪ সালে আনুষ্ঠানিক ভাবে উদ্যোগ শুরু করেন তিনি। মসলিন শাড়ি, হাতে সেলাইয়ের পণ্য, শো-পিস, নকশি কাঁথা, বেবি ড্রেস, ব্লক, স্ক্রিনপ্রিন্টের কাজ, পাঞ্জাবি ইত্যাদি দিয়ে তিনি তার স্টক সাজিয়েছেন। ভবিষ্যতে আরও কিছু পণ্য সংযুক্ত করার ইচ্ছা আছে তার। রাত-দিন নতুন নতুন ডিজাইন নিয়ে তিনি ও তার কর্মীবৃন্দ কাজ করে চলেছেন। একদিন সবাই যেখানে বলেছিলো, ‘ ওসব করে কী হবে? এর কোনো ভবিষ্যৎ নেই’। তারাই উদ্যোক্তা বর্ণার সবচেয়ে বড় শুভাকাঙ্ক্ষী।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘ওহী’জ ফ্যাশন স্টাইল’ নামে উদ্যোক্তার একটি পেজ আছে। সেখান থেকে তিনি তার ব্যবসায় পরিচালনা করেন। এ কাজে সাহায্য করার জন্য ৭/৮ জন নিজস্ব কর্মীও আছে। এখনো পর্যন্ত সরাসরি দেশের বাইরে না গেলেও দেশের মধ্যে যশোর, মাগুরা, রংপুর, চিটাগাং, ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় তার পণ্য পৌঁছে যাচ্ছে। পণ্য বিক্রি করে বর্তমানে মাসে দেড় লক্ষাধিক টাকা উপার্জন করছেন তিনি। খুব তাড়াতাড়ি ব্যাবসার পরিধি আরও বাড়াবেন বলে ভাবছেন তিনি।

আদি বাড়ি বরিশালে হলেও বর্ণার জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকার কল্যাণপুরে। বাবা ফজলুর রহমান ছিলেন ঠিকাদার। কিছুদিন আগে তিনি পরলোকগত হয়েছেন। মা আয়েশা বেগম একজন গৃহীণি। পাঁচ ভাই ও তিন বোনের মধ্যে বর্ণা তৃতীয়। অর্থনৈতিকভাবে তার পরিবারকে নিঃসন্দেহে সচ্ছলই বলা চলে। তবু বর্ণার সংগ্রাম ছিলো তার একার। আত্মমর্যাদার সংগ্রাম। ছোট্ট এই জীবনে জীবন ঘষে পাওয়া অভিজ্ঞতাকে তিনি নিজের মধ্যে সংকুচিত করে রাখতে চান না। ভবিষ্যতে নিজের একটি ট্রেনিং ইন্সটিটিউট খোলার ইচ্ছা আছে তার। যেখানে অসচ্ছল নারীদের বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ দেবেন তিনি। বর্ণা বিশ্বাস করেন, প্রত্যেকেরই আত্মসম্মানের সাথে নিজের পরিচয়ে বাঁচার অধিকার আছে। তবে সে অধিকার কেউ কাউকে দেবে না। অধিকার লড়ে নিতে হবে, অধিকার কেড়ে নিতে হবে।

সাইদ হাফিজ
উদ্যোক্তা বার্তা, খুলনা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here