বাংলাদেশী নারী উদ্যোক্তার নাম বললে সবার আগে যে নামগুলো আসবে তার মধ্যে অন্যতম আয়েশা জেসমিন। বাংলাদেশের নারী উদ্যোক্তাদের এগিয়ে যাওয়ার জন্য সব সময় কাজ করে যাচ্ছেন তিনি।
“আমরা সব সময় সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবোনা,ব্যর্থতা জীবন সাফল্যর বিপরীত কিছু নয়, উদ্যোক্তা জীবনে ব্যর্থতা সাফল্যের অংশ”। এটা আমাদের মেনে নিতে হবে।
যেকোনো উদ্যোগে নামার আগে এটাই হৃদয়ে গেঁথে নিতে হবে। লেগে থাকতে হবে ধৈর্য্য নিয়ে। হার না মেনে জারি রাখতে হবে লড়াই। আয়েশা জেসমিন এর আদর্শ এমনই। এমনটাই বিশ্বাস করেন তিনি। শুধু নারী উদ্যোক্তা হিসেবে নয়, বাংলাদেশের প্রথম পাঁচজন প্রধান উদ্যোক্তাদের মধ্যে তিনি একজন। এই ডিজিটাল বাংলাদেশে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বড় প্রেরণার নাম আয়েশা জেসমিন। তাঁর মেধা, দক্ষতা ও বহুমুখী উদ্যোগে হাজারো মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। তাই তাঁকে জানা মানে উদ্যোক্তা হিসেবে নিজের জানাকে আরেকটু এগিয়ে নেয়া।
আয়েশা জেসমিন এর জন্ম ভোলায়। ফজিলাতুন্নেসা মহিলা ডিগ্রি কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করার পর ১৯৯২ সালে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। সেই বিয়ের বছর স্বামীর সাথে চলে আসেন ঢাকায়। স্বামী সোনালী ব্যাংকে চাকুরীরত, ঢাকায় আসার পর দিনের বেশির ভাগ সময় আয়েশা জেসমিন কে একাই বাসায় কাটাতে হতো। ব্যস্ততম এই ঢাকা শহরে জীবন ধারণের জন্য এক জনের আয়ে সংসার চালাতে বেশ কষ্ট করতে হয়। এই রকম পরিস্থিতিতে আয়েশা জেসমিন চিন্তা করলেন ঘরে বসে না থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে হাতের কাজের উপর প্রশিক্ষণ নিলে ইনশাআল্লাহ তিনি কিছু একটা কাজ করে সংসারে স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে আনতে পারবেন। অবশেষে আয়েশা জেসমিন ঢাকার মিরপুরের সমাজকল্যাণ অধিদপ্তর থেকে কৃত্রিম ফুল তৈরি,কনফেকশনারি, চাইনিজ রান্না কোর্স, সেলাই, ব্লক-বাটিক, কাটিং মেশিনের ওপর এমব্রয়ডারিসহ নানা বিষয়ের উপর কার্যকরী কোর্স দক্ষতার সাথে সম্পন্ন করেন।
আয়েশা জেসমিন সবসময় নিজেকে প্রশিক্ষক হিসেবে গড়ে তুলতে প্রশিক্ষণের বিষয়ে খুব মনোযোগী ছিলেন। সময়ের সাথে আয়েশা জেসমিন কে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে। তিনি বিশ্বাস করতেন অর্থ কোনো বিষয় নয় ,প্রয়োজন শুধু চিন্তা, ইচ্ছা ও কাজের মনোবল। কোনো কাজকে তিনি ছোট মনে করেন না। ছোট বড় সকল কাজেই আয়েশা জেসমিন এগিয়ে যেতেন। যাতে অন্য মানুষও কাজের প্রতি উৎসাহী হন। কাজ শেখার প্রতি তাঁর আছে অফুরন্ত আগ্রহ। কাজ শেখার জন্য ছুটে গেছেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।
সপ্তবর্ণা থেকে শেখানো হয় বিভিন্ন ধরনের রান্না, পুঁতির কাজ, ব্যাগ, ওয়ালম্যাট ও শোপিস তৈরি, বাটিক প্রিন্ট, বুটিকস আইটেম, পারফিউম, চাইনিজ রান্না, বাংলা খাবার, বিভিন্ন ধরণের পিঠা, মিষ্টি সহ মোট ৪০ টি আইটেমের নানা ধরনের কোর্স। এই কাজের পাশাপাশি আয়েশা জেসমিন কর্মরত ছিলেন মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের জেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয়ের জীবিকায়ন প্রকল্পের ফুড প্রসেসিং প্রশিক্ষক হিসেবে ২০১৩ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত।
সপ্তবর্ণার শুরুর দিকে মাত্র তিনজন কর্মী থাকলেও এখন তাঁর অধীনে কাজ করছেন সব মিলিয়ে ১৫ জন কর্মী। সব মিলিয়ে এখন তাঁর মূলধন ১কোটি টাকা। মাসিক আয় দাঁড়িয়েছে প্রায় দুই থেকে আড়াই লক্ষ টাকা। প্রশিক্ষণ ছাড়াও রান্না ও হস্তশিল্প বিষয়ক পণ্য পাইকারি, খুচরা বিক্রিসহ বিভিন্ন যুবমেলা, বিসিক মেলা, বৈশাখী মেলা, এসএমই মেলা, বাণিজ্য মেলা, ও বিভিন্ন বেসরকারি মেলাতেও উপস্থিতি সপ্তবর্ণার কার্যক্রম। স্বপ্ন আছে প্রতিষ্ঠানটি সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবার ।
উদ্যোক্তা সপ্তবর্ণা সম্পর্কে বলেন- ” মিরপুরে ৩০০০স্কয়ারে ফিট এর একটি ফ্ল্যাট , যেখানে ১৫০০ স্কয়ারে ফিট এ তিনি পরিবার নিয়ে থাকেন , আর বাকি ১৫০০স্কয়ারে ফিট এ সপ্তবর্ণার অফিস, এই অফিসে ৪০ জনের ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন প্রশিক্ষনার্থী একসাথে প্রশিক্ষণ নিতে পারেন। এই পর্যন্ত সপ্তবর্ণা একাডেমি থেকে ২০,০০০ এর বেশি প্রশিক্ষণার্থী প্রশিক্ষণ নিয়ে বের হয়ে গেছেন। তার মধ্যে ৫৭ জন আমেরিকান প্রশিক্ষণার্থী ছিলেন। “
আয়েশা জেসমিন তাঁর কর্মময় জীবনে অনেক সম্মাননা পেয়েছে। এতসব সম্মাননা তিনি গ্রহণ করেছেন নীরবে। জীবনের এই সমস্ত সম্মাননা তাঁকে করেছে বিনম্র।
২০০০ সালে পান যুব উন্নয়ন পুরস্কার। কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য ২০১৫ সালে তাঁকে দেওয়া হয় জাতীয় যুব উন্নয়ন পুরস্কার। জাতীয় আচার প্রতিযোগিতায় ৪ বার পুরস্কার পান ২০০৮,২০১০,২০১৫,এবং ২০১৬ সালে। রন্ধনশিল্পে বিশেষ অবদানের জন্য ২০১৬ সালে পেয়েছেন পিস ফর হিউম্যান থেকে মাদার তেরেসা সম্মাননা। ফেভিক্রিল হস্তশিল্প প্রশিক্ষণে অসামান্য অবদানের জন্য পেয়েছেন ২০১৬-১৭ সালে সম্মাননা স্মারক। কুকিং অ্যাসোসিয়েশন আয়োজিত ২০১৬ সালের পিঠা প্রতিযোগিতায় পেয়েছেন চতুর্থ স্থান। উদ্যোক্তা, নারী উন্নয়ন ও সমাজ সেবায় বিশেষ অবদানের জন্য বিশ্ব বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে দেওয়া হয় বিশেষ গুণীজন সম্মাননা ২০১৬। প্রাণ আচার প্রতিযোগিতায় সেরা পুরস্কারসহ আরো অনেক সম্মাননা।
এতো সব সম্মাননা পাওয়া প্রসঙ্গে উদ্যোক্তা আয়েশা জেসমিন বলেন -” মানুষকে শক্তিশালী করতে কর্ম শেখানো ,এবং কর্মের বিস্তারের জন্য প্রতিষ্ঠান করা প্রয়োজন। আর এই বিশ্বাস কে ধারণ করে তিনি নিরন্তন কাজ করছেন দুঃস্থ ও অসহায় মানুষ বিশেষ করে নারীদের জীবন সাজাতে। অনেক দুঃস্থ ও অসহায় নারীদের হাতকে তিনি পরিণত করেছেন কর্মীর শক্তিশালী হাতে।
উদ্যোক্তা দীর্ঘ এই কর্মময় জীবনে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সমূহের জড়িত থাকার মাধ্যমে নিরলস সেবা প্রদান করে যাচ্ছেন: ২০০৫ সাল থেকে কসমোপলিটান স্কুলএন্ড কলেজের এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও ডিরেক্টর, কসমোপলিটান এসোসিয়েশন এর কুকিং সম্পাদিকা। হিউমান এনভায়রনমেন্ট অর্গানিজশন এর এক্সিকিউটিভ মেম্বার, যুব উন্নয়নের ট্রেইনার এবং মানবিক ও হিউমান রাইটস সোসাইটির সমাজ কল্যাণ সম্পাদিকা। বাংলাদেশ ইয়ুথ এটারপ্রেনার এ এডভাইস হেল্প সেন্টার এর কাজ করছেন। এছাড়া দেশের বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে সফল ট্রেইনার হিসেবে যুক্ত আছেন। জেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরে ফুড প্রসেসিংয়ে বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছে।
আয়েশা জেসমিন আগামী দিনের নারী উদ্যোক্তাদের প্রতি লক্ষ্য করে বলেন, নারীদের অগ্রগতির জন্য শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। তবে সার্টিফিকেট অর্জনের জন্য শিক্ষা নয় বরং নিজেকে আলোকিত করে এমন ধরণের শিক্ষা প্রয়োজন। যে শিক্ষা নারীকে আত্মবিশ্বাসী করে, সে ধরণের কর্মমুখী শিক্ষা।
নারী বিকাশের জন্য সমাজ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া প্রয়োজন বলে তিনি বিশ্বাস করেন।
ডেস্ক রিপোর্ট, উদ্যোক্তা বার্তা