লেজারকাট প্রোডাক্টে উদ্ভাসিত নূপুর

0
উদ্যোক্তা- পায়েল আক্তার নুপুর

নুপুরের নিক্কণ ধ্বনি কার না ভালো লাগে? কতো গান-গল্প-কবিতাও তো রচিত হয়েছে এই নুপুরকে কেন্দ্র করে। শোনা যায়, সম্রাট অশোক পালের ছোট ভাই গুররাম ইতিহাসে প্রথম নুপুর-এর প্রচলন ঘটিয়েছিলেন। কিন্তু না, আজ আমরা ‘অলঙ্কার নুপুর’-কে নিয়ে কথা বলবো না; কথা বলবো আমাদের সম্মানিত সফল নারী শিল্পোদ্যোক্তা পায়েল আক্তার নুপুর-কে নিয়ে। কর্মজীবনে অসাধারণ উদ্যোগ গ্রহণ করে যিনি তার জীবনকে করে তুলেছেন নুপুরের নিক্কণ ধ্বনির মতো ব্যঞ্জনাময়।

ছোটবেলা থেকে মনের মধ্যে একটু একটু করে স্বপ্ন আঁকতে আঁকতে বড় হয়েছেন নুপুর। মাত্র ১০বছর বয়স থেকে নিজেকে জীবন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করতে শুরু করেছিলেন। হতে চেয়েছিলেন একজন সফল উদ্যোক্তা। ঢাকার মেয়ে নুপুর, প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার গণ্ডি পেরিয়েছেন মিরপুরের আলিউদ্দিন স্কুল আর বাংলা কলেজ থেকে। এখন নার্সিং নিয়ে পড়ছেন। তবে কর্মের জন্য নয়, মানবতার সেবার জন্য।

২০০৮ সালের কথা, নুপুর শুরু করলেন তার কর্মজীবন। প্রথমে তিনি যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। তারপর সেই প্রশিক্ষণের সাময়িক সনদ দিয়ে ‘পিকেএসএফ’ নামক একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষক হিসেবে চাকরি নিলেন। কিন্তু উদ্যোক্তা হওয়ার পোকা ততোদিনে তার মাথায় আস্তানা গেড়ে ফেলেছিলো। তাই চাকরির পাশাপাশি একটি বিউটি পার্লার খুলে বসেন তিনি। তবে শুরুতেই বাঁধলো বিপত্তি। চাকরির ব্যস্ততার কারণে পার্লারে ঠিক মতো সময় দেওয়াটা হয়ে উঠছিলো না। অগত্যা লোক দিয়ে পার্লার চালাতে হচ্ছিলো। তাতে যা হবার তা-ই হলো। প্রথমবারেই ব্যবসায় লোকসান গুনে পাত্তাড়ি গুটিয়ে ফেলতে হলো।

কিন্তু নুপুর দমে যাওয়ার পাত্রী নন। নতুন উদ্যোমে নিজেকে প্রস্তুত করলেন। পার্লার নয়, এবার কাজ শুরু করলেন বুটিক-টেলারিং নিয়ে । ২০১৩ সালে মিরপুরে একটি শো-রুমও খুললেন। পাশাপাশি যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের পিডি লাইট প্রশিক্ষক হিসেবেও কাজ করে যাচ্ছিলেন। কিন্তু বিধি বাম। এবারও চাকরির পাশাপাশি ব্যবসায়টা ঠিক মতো সামলাতে পারলেন না।

তবে কি নিভে গেলো আমাদের নুপুরের উদ্যোক্তা হয়ে ঝনঝন করে বেজে ওঠার স্বপ্ন? না। নুপুর জাত স্বপ্নবাজ। তাই সিসিফাসের মতো পড়ে গিয়ে আবারও উঠে দাঁড়াতে জানেন। এবার তিনি আগের ত্রুটিগুলো সুধরে ব্যবসায় পুরোপুরি আত্মনিয়োগ করলেন। তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন, লক্ষ্যে অটুট থাকলে বিজয় একদিন আসবেই। ঘটলোও তাই।

১৭ বছর পর ব্যবসায়ে সফলতা আসলো লেজার কাটিং-এ। শক্তিশালী লেজার ব্যবহার করে ফেব্রিকস, কাগজ, প্লাস্টিক, কাঠ ইত্যাদির মতো ফ্ল্যাট শিট উপকরণগুলি কাটা বা খোদাই করার যন্ত্রের নামই লেজার কাটিং। ২০২০ সালে চায়না থেকে একটি লেজার কাটিং মেশিন আনলেন। জানুয়ারি মাসে কামরাঙ্গীরচরে খুললেন লেজার কাটিং-এর একটি কারখানা। শুরু করলেন কলমদানি, টিস্যু বক্স, শো-পিস, বিয়ের কার্ড-সহ বিভিন্ন ধরণের নান্দনিক পণ্য ও পণ্যের কাঁচামাল তৈরি। তবে এবার বাঁধ সাধলো মহামারি করোনা। মার্চ-এ লকডাউন হয়ে গেলো। কিন্তু থেমে থাকলেন না উদ্যোক্তা। প্রথম দফা লকডাউন শেষে আবার একটা মেশিন আনলেন। এভাবে লকডাউনের ফাঁকে ফাঁকে ৬টি ডাবল ও ১টি সিঙ্গেলসহ মোট ১৩টি লেজার কাটিং মেশিন আনলেন। একেকটা মেশিনের দাম ৮ লক্ষ থেকে ১৬ লাখ টাকা পর্যন্ত। কামরাঙ্গীরচরের পর কেরানীগঞ্জে স্থাপন করলেন লেজার কাটিং-এর আরও একটি কারখানা। পাশাপাশি মিরপুর-১-এর মাজার কো-আপরেটিভ মার্কেট-এর তৃতীয় তলায় ‘নুপুর লেজার প্রোডাক্ট’ নামে একটি শো-রুমও খুলেছেন উদ্যোক্তা পায়েল আক্তার নুপুর।

বর্তমানে তার কারখানায় নিয়মিত ও অনিয়মিত মিলিয়ে ২০ জন কর্মী দিন-রাত কাজ করে যাচ্ছেন। উৎপাদিত পণ্য বিক্রি হচ্ছে সারা দেশে আর কাঁচামাল চলে যাচ্ছে বাংলা বাজারের পাইকারদের কাছে। এমনকি ইংল্যান্ড, ভারত, দুবাই-সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানিও হচ্ছে তার তৈরি পণ্য। উদ্যোক্তা মনে করেন, বাজারে তার পণ্যের চাহিদা অনেক বেশি। যা মেটাতে তার আরও মেশিন লাগবে। তিনি বলেন, ‘যদি আপনি এ-ব্যবসায় প্রতিযোগের বাজারে এগিয়ে থাকতে চান তাহলে লেজার কাটিং-এর অত্যাধুনিক সরঞ্জামগুলো সরবরাহ করা খুব জরুরি’।

একসময় মাত্র দশ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে শুরু করা উদ্যোক্তা নুপুর আজ মাসেই তৈরি করেন সাড়ে উনিশ লক্ষ পিস পণ্য। যার বাজার মূল্য প্রায় চল্লিশ লাখ টাকা। ভাবতে পারেন? যদি প্রথমবার ব্যবসায়-এর কণ্টকাকীর্ণ পথ দেখে তিনি ভয়ে পালিয়ে যেতেন, তবে কি আজ এ-অসাধ্য সাধন সম্ভব হতো? দৃঢ় মনোবল, প্রচণ্ড ইচ্ছা শক্তি ও প্রাণান্তকর সাধনা তাকে এনে দিয়েছে এই সাফল্য। নুপুর যেমন সফল নারী উদ্যোক্তাদের দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন তেমনি নুপুরকে দেখেও যদি আজকের নারীরা অনুপ্রাণিত হন তবে তারাও হয়ে উঠতে পারেন – নুপুরের মতো একেকটি অলঙ্কার।

সাইদ হাফিজ
উদ্যোক্তা বার্তা, খুলনা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here