রং তুলিতে চাঁদের আলো ছড়াচ্ছেন উদ্যোক্তা শশী

0
উদ্যোক্তা ঈশনা শশী

ছোটবেলা থেকেই আঁকাআঁকির প্রতি ছিল তার প্রবল আকর্ষণ। সবাই তার ড্রয়িং-এর প্রশংসা করতো। প্রবল ইচ্ছে ছিল বড় হয়ে রং তুলিতে সৃজনশীল কিছু করবেন। নানা প্রতিকূলতা ছাপিয়ে বাল্যকালের সেই ভালোবাসাকে বাস্তবে রূপ দিলেন ঈশনা শশী।

বড় বোন শিমুর হাত ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘুরতে যেতেন। তখন ছোট্ট শশী স্বপ্ন দেখতেন একদিন তিনি চারুকলার ছাত্রী হবেন। একটা বুটিক হাউস দেয়ার স্বপ্নও দেখেছিলেন, যেখানে তার ডিজাইন করা কাপড়, তার আঁকা ছবি, তার ডিজাইন করা শো-পিসসহ আরও অনেক কিছু থাকবে। আজ স্বপ্ন পূরণের অনেকটাই কাছাকাছি তিনি, ডানা মেলা স্বপ্নেরা বাসাও বেঁধেছে, তবে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে চাঁদের আলো ছড়ানোর মতো ভিন্ন এক মাধ্যমের উদ্যোক্তা হয়েছেন শশী।

এজন্য অনেক উত্থান-পতন দেখতে হয়েছে তাকে, পাড়ি দিতে হয়েছে কঠিন পথ।

ড্রয়িং-এর প্রতি আর্কষণ থাকলেও বাবা চেয়েছিলেন অন্য কিছু। মেয়েকে ইঞ্জিনিয়ারিং-এ পড়াতে চান, তাই এসএসসি পাশ করার পর ডিপ্লোমা কোর্সে ভর্তি করিয়ে দেন। মূলত শশী আর্কিটেকচারে ভর্তি হবেন ভেবেই বাবার কথায় রাজি হয়েছিলেন। কিন্তু চারুকলার মতো আর্কিটেকচারে পড়ার স্বপ্নও পূরণ হলো না। মানসিকভাবে প্রচণ্ড ভেঙে পড়েন তিনি। তারপরও বাল্যকালের ভালোবাসা ধরে রাখতে গ্রাফিক্স ডিজাইন, ওয়েবসাইট ডিজাইন শিখেছেন। যাকে বলে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো। সেটিও অবশ্য কাজে লাগাতে পারেননি শশী। ২০০৮-এর ডিসেম্বরে খুব কম বয়সে বিয়ে হয়ে যায়। তারপর এক সন্তানকে সামলে খুব কষ্ট করে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করেন।

ডিপ্লোমা শেষ করে ছয় মাস জুনিয়ার আইটি অফিসার হিসেবে চাকরি করেন। নানা সীমাবদ্ধতায় বিএসসি আর করা হয়নি। পরে যুক্ত হলেন শিক্ষকতা পেশায়। তারপরও মনের ভেতর সেই ছোটবেলার স্বপ্নটা উঁকি দিতো। এর মধ্যে ২০২০ সালে লকডাউনে স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় গৃহবন্দী হয়ে পড়েন।

তবে মহামারী করোনা তার জন্য ভিন্ন কিছু নিয়ে আসে।

সেসময় বড় বোন ও দুলাভাইয়ের অনুপ্রেরণায় দুলাভাইয়ের দোকান থেকে থ্রি-পিস এনে অনলাইনে ব্যবসায় শুরু করেন। তেমন কোনো পরিকল্পনাই ছিলো না তার। কিন্তু কয়েকমাস পর বুঝতে পারেন অনলাইনে ব্যবসা করতে গেলে ব্যতিক্রমী কিছু নিয়ে কাজ করতে হবে। তখন মাথায় আসে ছোটবেলার আঁকাআঁকির কথা। হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসা নিয়ে কাজ করার সাহস খুঁজে পান উইয়ের মাধ্যমে। মাত্র এক হাজার টাকা খরচ করে রং তুলি ও সুপারি পাতার প্লেট কিনে কাজ শুরু করেন। প্রথম অনলাইন অর্ডার পান নারী উদ্যোক্তা ফোরাম গ্রুপ থেকে। অল্প সময়ের মধ্যে বেশ সাড়া পেতে শুরু করেন। একদিন ইটালি থেকে তার বান্ধবী সুপারি পাতার প্লেটে করা ক্যালিওগ্রাফির অর্ডার দেন। সে ধারাবাহিকতায় ইউরোপ পেরিয়ে আমেরিকাতেও গিয়েছে তার সুপারি পাতার খোল শিল্প যা এখন ঈশনা শশী’র সিগনেচার পণ্য।

এখন সুপারি পাতার খোলের তৈরী প্লেটের ভেতর আরবি ক্যালিওগ্রাফি ও বিভিন্ন পেইন্টিং নিয়ে তিনি কাজ করছেন। শাড়ি, পাঞ্জাবী, কুর্তি, টু-পিস, ওড়নাতে হ্যান্ডপেইন্ট করেন। কাঁচের বিভিন্ন আইটেমে করেন গ্লাসপেইন্টিং। মাটির পট, ছোট পাতিল, গ্লাস ইত্যাদিতেও আঁকাআঁকি করেন। এমনকি ক্যানভাস পেইন্টিংও তিনি করেন। পণ্য তৈরী থেকে শুরু করে ডেলিভারি পর্যন্ত সব কাজ শশী নিজেই বাসা থেকে করেন। এসব কাজে তাকে সহায়তা করেন স্বামী, বড় বোন ও মেয়ে। পাশাপাশি তার দু’জন শিক্ষার্থী আছে যারা কাজ শেখার পাশাপাশি অনেক সাহায্যও করে। দুটি অনলাইন প্লাটফর্মের মাধ্যমে তিনি তার উদ্যোগ পরিচালনা করেন, যার একটি হচ্ছে ‘Ishnaz’। এখানে তিনি পোশাকের সাথে সম্পর্কিত পণ্যগুলো উপস্থাপন করেন। অন্যটি হচ্ছে সুপারি পাতার খোল যেখানে সুপারি পাতার পেইন্টিং-এর সাথে অন্যান্য ডেকোরেটিং আইটেমগুলো বিক্রি করেন তিনি।

উদ্যোক্তা শশী মূলত প্রি-অর্ডার পণ্য নিয়ে কাজ করেন। কারণ বেশিরভাগ কাজ নিজের হাতে একা করতে হয়, একসঙ্গে অনেক বেশি করা সম্ভব হয় না। তবে আগামীতে শশী তার উদ্যোগকে একটি ব্র্যান্ড হিসেবে দেখতে চান। একটি শো-রুম নেওয়ার পরিকল্পনাও আছে তার। পাশাপাশি তিনি সৃজনশীল নারীদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে চান।

উদ্যোক্তা বার্তাকে ঈশনা শশী বলেন: যে মায়েরা সন্তানের জন্য কাজে যেতে পারেন না তাদের কাজের জায়গাটা এমনভাবে তৈরী করতে চাই যেন তারা সন্তান নিয়েই কাজ করতে পারেন। তারা তাদের প্রতিভা কাজে লাগাতে পারেন।

মরহুম রুহুল আমিন এবং মরহুমা জাহানারা বেগমের ছোট মেয়ে ঈশনা শশী। বাবা ছিলেন প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা। গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহ হলেও জন্ম এবং বেড়ে ওঠা ঢাকার মিরপুরে। এমডিসি মডেল ইন্সটিটিউট থেকে এসএসসি পাশ করেন, ডিপ্লোমা ইন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং করেন ঢাকা মহিলা পলিটেকনিক থেকে। দুই কন্যা সন্তানের জননী শশী প্রচণ্ড আত্নতৃপ্তি নিয়ে তার উদ্যোগকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।

তিনি উদ্যোক্তা বার্তাকে বলেন, “একদিন আমার বড় আপু আমার কাজের ঘরে ঢুকে বলে, আমাদের ছোট্ট শশী যে একদিন রং তুলি কেনার জন্য টাকা জমাতো, আজ তার ঘর ভর্তি রং। তখন আমার নিজেকে খুব সৌভাগ্যবান মনে হয়। যে আমি একদিন নিজের মনের খোরাক পূরণের জন্য একটু ছুঁতো খুঁজতাম, সেই আমার এখন দিনরাত কাটে সেই ভালোবাসার কাজ নিয়ে। এটা চরম সৌভাগ্যের।”

সেতু ইসরাত,
উদ্যোক্তা বার্তা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here