নিজ স্বপ্ন পূরণের পর এবারে অন্যের স্বপ্ন পূরণে কাজ করছেন রাজশাহীর সোনিয়া খাঁন রিনি

0
উদ্যোক্তা সোনিয়া খান রিনি

চারশোর বেশি নারীকে কুকিং এবং বেকিং প্রশিক্ষণ দিয়েছেন উদ্যোক্তা সোনিয়া খান রিনি। তাদের ৮৫ শতাংশই এখন উদ্যোক্তা। রাজশাহীর অসংখ্য প্রতিষ্ঠিত উদ্যোক্তাও তার স্টুডেন্ট, সাথে নওগাঁ, চুয়াডাঙ্গাতেও তার শিক্ষার্থী রয়েছে। এছাড়া সিডনি, অস্ট্রেলিয়া, নিউইয়র্ক, জাপান, কানাডা এবং পর্তুগালের অনেক প্রবাসী বাংলাদেশিও রিনি’স কিচেন থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।

দীর্ঘদিন হোমমেইড ফুড নিয়ে কাজ করার পর একবছর আগে সিল্কসিটির উপশহর এলাকায় রিনি’স কিচেন নামে একটি রেস্টুরেন্ট গড়েন এই উদ্যোক্তা। নগরীর বাসিন্দাদের বরাবরই চাহিদার শীর্ষে থাকা রিনি’স কিচেনের বিভিন্ন ধরনের কেকের সাথে রয়েছে পেটিস, সিজলিং চিকেন চাওমিন,ফালুদা, ডোনাট, পিজ্জা, বার্গার, পাস্তা, তিরামিসু, ড্রিংকসসহ দেশীয়, চায়নিজ, ইটালিয়ান ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের খাবার। বেশ কিছু সেট মেনুও রয়েছে এখানে। ৪৫ জন একসাথে বসতে পারবেন এমন ধারণ ক্ষমতা রিনি’স কিচেনের। এখানে ছোট পরিসরের মিটিং, পারিবারিক প্রোগ্রাম হয়ে থাকে। বর্তমানে আট জন সহযোদ্ধা কাজ করছেন উদ্যোক্তার সঙ্গে।

২০১৯, ২০২০ এবং ২০২১ সালে নগরীর জনপ্রিয় প্রতিষ্ঠান ফ্রেন্ডস পিকে হোমমেইড পেস্ট্রি এবং ফুড ফেয়ারের আয়োজন করেছিলেন রিনি। যেখানে তার সাথে আরো অনেক উদ্যোক্তা অংশ নেন। আগামীতে আবারও বড় পরিসরে মেলা করার ইচ্ছে রয়েছে তার।

উদ্যোক্তা বার্তার সাথে কথপোকথনে রিনি বলেন, “আমার আগে থেকে কোন পরিকল্পনা ছিল না খাবার নিয়ে কাজ করার। তারপর যখন সিদ্ধান্ত নিলাম কাজ করবো, নিজে-নিজে এক্সপেরিমেন্ট চালাতাম। এমনও হয়েছে একটি কেক তৈরি করতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ভুল হয়েছে। একেক সময় যে ভুল হতো পরেরবার সেগুলো মাথায় রাখতাম। এভাবে বহুবার চেষ্টার পর সফল হতাম। তাই আমার স্টুডেন্টরা যখন আমায় বলে, ম্যাম বা আপু- আমার কেকটা এমন হলো কেন? অথবা এই রান্নাটা এমন কেন হলো? একবার তাকিয়েই ভুলটি বুঝতে পারি। কেননা ওই ভুলগুলো আমি বহুবার করেছি। ভুল করতে-করতে শিখেছি।”

নিজে কিছু করতেই হবে এই ভাবনা থেকে উদ্যোক্তা জীবনে এসেছিলেন রিনি। শুরু করেছিলেন শাড়িতে হ্যান্ডপেইন্ট, ব্লক-বাটিকের কাজ দিয়ে। রাজশাহীর উপশহর এলাকায় তার শাড়ির শোরুম ছিলো। তার সাথে আরো দুজন মেয়ে কাজ করতেন। কিছুদিন যাওয়ার পর হাসবেন্ড বললেন, তুমি এই কাজগুলো করতে যেয়ে ছেলেকে, আমাকে কম সময় দিচ্ছো। এগুলোর প্রয়োজন নেই। আমি চাকরি করছি তুমি সংসার সামলাও। এরপর শাড়ির শোরুম বন্ধ করে দিলেন তিনি।

সেসময় হাসিমুখে কথাটি গ্রহণ করতে মন সায় দেয়নি তার। কাজপ্রেমী রিনির সবসময়ই ইচ্ছে ছিল নিজে কিছু না কিছু করবেনই। কিছুদিন পর আয়ুর্বেদিক পণ্য নিয়ে কাজ শুরু করলেন। রাজধানী ঢাকা থেকে বেশ কয়েকটি প্রশিক্ষণও নিলেন এই বিষয়ে। রাজশাহীতে বেশ ভালোই সাড়া পাচ্ছিলেন। তাই চিন্তা করলেন একটা শোরুম নেবেন। কিন্তু যে বাসাই দেখতে যান বাড়িওয়ালারা বলেন, এসব পণ্য নিয়ে কাজ করছেন- তার মানে বিউটি পার্লার দিতে চাচ্ছেন। না এই জন্য আমার বাসা ভাড়া দেবো না। এভাবে বেশ কিছু সমস্যা সৃষ্টি হলে ওই উদ্যোগও বন্ধ করে দেন সোনিয়া খান রিনি। এরপর বাসায় যখন বসে থাকতে শুরু করলেন তখন ছেলে-মেয়েদের বিভিন্ন নাস্তা তৈরি করে দিতেন। আত্মীয়-স্বজনদের জন্যও বিভিন্ন ধরনের নাস্তা তৈরি করতেন। খুব প্রশংসা পাচ্ছিলেন খাবারগুলোর জন্য।

একটা সময় মনে হলো তিনি তো এগুলো নিয়েও কাজ করতে পারেন। তাই অনলাইনে তার আইডি থেকে তার তৈরি খাবারগুলো সুন্দরভাবে ডেকরেশন করে পোস্ট দিতে শুরু করেন।

শুরু হলো জীবনের নতুন অধ্যায়। অর্ডার আসতে শুরু করলো। প্রথম অর্ডার পান সামুচার। এভাবে অর্ডার আসতে আসতে লক্ষ্য করেন অপরিচিতরা তার খাবার বেশি নিচ্ছেন। কয়েকদিনের মধ্যেই রিপিট ক্রেতার তালিকাভুক্ত হতে লাগলেন অনেকে। বিষয়টিতে বেশ অনুপ্রাণিত হন সোনিয়া খান রিনি। হঠাৎ একদিন কল আসে রাজশাহীর স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব ওয়াহিদা খানম লিপির কাছ থেকে। তিনি রিনির কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নেওয়ার আগ্রহ দেখান। তিনিই ছিলেন রিনির প্রথম স্টুডেন্ট। এখন পর্যন্ত ৪০০ বেশি নারীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন তিনি।

কুকিং এবং বেকিং-এ কোনটা ৪ দিনের কোর্স, কোনটা ১ মাসের, চাইনিজ-ইটালিয়ান খাবারগুলোর কোর্স ৬ দিনের। বাকিগুলো সিঙ্গেল কোর্স করিয়ে থাকেন রিনি’স কিচেন এর স্বত্ত্বাধিকারী এবং অসংখ্য কালিনারি উদ্যোক্তার গুরু সোনিয়া খান রিনি। সামাজিক পাতায় রিনি’স কিচেন রাজশাহী নামে পেজ রয়েছে এই উদ্যোক্তার। তিনি শুধুমাত্র রাজশাহীতে খাবারগুলো ডেলিভারি করে থাকেন।

ঢাকা, নওগাঁ, নাটোর সহ দূর-দূরান্তেও তার কিছু ক্লায়েন্ট রয়েছেন যারা নিজ দায়িত্বে সরাসরি এসে কেক নিয়ে যান। আগামীতে বৃহৎ পরিসরে একটি পার্টি পয়েন্ট করার ইচ্ছে রয়েছে সোনিয়া খান রিনির।

স্বামী একটা সময় বলেছিলেন, ‘আমি তো চাকরি করছি তুমি সংসার সামলাও।’ আজ স্বামী গোলজার হোসেন রিনিস কিচেনের একজন ফাউন্ডার। নিজের চাকরি ছেড়ে সহধর্মিণীর এই উদ্যোগে যোগ দিয়ে যৌথভাবে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। সন্তানরাও বাবা-মায়ের পাশে রয়েছেন সবসময়। তারাও তাদের মতামত জানাচ্ছেন বাবা-মাকে।

করোনা পরিস্থিতি শুরু হলে মানবিক দিক থেকেও এগিয়ে এসেছিলেন এই উদ্যোক্তা। ১৫০০ মণ চাল, ডালসহ কয়েক ধরণের উপহার সামগ্রী নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন নগরীর মেহনতী মানুষের পাশে। এই কাজের স্বীকৃতি হিসেবে দিলসাদ রাবেয়া আয়োজিত একটি প্রোগ্রামে সম্মাননা পেয়েছেন সোনিয়া খান রিনি। এছাড়াও সম্প্রতি ফ্রেন্ডস পিকে কালিনারি উদ্যোক্তাদের নিয়ে অনুষ্ঠিত এক প্রোগ্রামে রিনির স্টুডেন্টদের সামনে তাকে সম্মানিত করতে মেডেল পরিয়ে দেন শেফ ডেনিয়েল গোমেজ।

এই উদ্যোক্তার জন্ম থেকে বেড়ে উঠা রাজশাহীর নওহাটা এলাকায়। অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যায় রিনির। বৈবাহিক সূত্রে আট বছর কুষ্টিয়াতে অবস্থানের পর রাজশাহী শহরে চলে আসেন রিনি। এরপর শুরু হয় স্বপ্ন পূরণের পথে যাত্রা। আজ নিজ স্বপ্ন বাস্তবায়নের পর অন্যের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে কাজ করে যাচ্ছেন সোনিয়া খান।

তামান্না ইমাম
উদ্যোক্তা বার্তা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here