উদ্যোক্তা মোক্তার হোসেন শিকদার

নব্বই দশকের দিকে মাত্র দশ বছরের একটি ছেলে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গন্ডি তখনও পেরোয়নি। সেই মুহূর্তে তার বাবা প্রচুর পরিমানে ঋণে জর্জরিত। মানুষের অত্যাচারে গ্রাম থেকে পালিয়ে যায় ছেলেটির বাবা। ছেলেটি এবং ছেলেটির পরিবার জানেনা তার বাবা কোথায় চলে গেছে। অর্ধাহারে অনাহারে দিনাতিপাত করছে! ছেলেটির নাম মোক্তার হোসেন শিকদার।

ক্ষুধার যন্ত্রনায় পড়ার চিন্তা ভুলে হঠাৎ করে টরকি টু ঢাকা গামী লঞ্চে উঠে ছেলেটি অজানা উদ্দেশ্য নিয়ে ঢাকা মুখী হতে যাচ্ছে। পথিমধ্যে কিছু ছেলেদের বাদাম বিক্রি করতে দেখে এবং কৌতূহল বসত ওদের কাছ থেকে জানতে পারে ২/৩ কেজি বাদাম বিক্রি করলে ১৩/১৪’টাকা আয় হয়। অনাহারী ছেলেটি ভাবে এই কাজটি করতে পারলে অন্তত আমার পরিবার নিয়ে ভাত টুকু খেতে পারব! কিন্তু আমার কাছে তো কোন টাকা নেই, পুঁজি কোথায় পাব?? লঞ্চে থাকা অবস্থায় একজন যাত্রীর বস্তা বহন করে প্রথম ২ টাকা হাতে আসলো। সেখান থেকে আরো কয়েকটি বোঝা বহন করে কিছু টাকা সংগ্রহ করে বাড়িতে এসে মায়ের সাথে যুক্তি করে বাদাম বিক্রি শুরু করে। আস্তে আস্তে খাবার সংগ্রহ করার সাথে বাবার দেনা পরিশোধ করতে সক্ষম হয়। এভাবে চলার পর ছেলেটির বয়স যখন ১৫ তখন তার মনে হলো বাদাম বিক্রি কোন পরিচয় নয়!!

তারপর মোক্তার হোসেন আবার ব্যস্ত শহর ঢাকা গিয়ে একটি চানাচুর ফ্যাক্টরি তে কাজ করে। কিছু বছর পরে তার রোজগার ভালো হচ্ছে মনে করে ঢাকার একটি মেয়েকে বিয়ে করে। হঠাৎ তার মা অসুস্থ হওয়াতে গ্রামের বাড়িতে চলে আসে। এবং মা সুস্থ হয়ে মায়ের পূঁজি করা কিছু অর্থ (৪৫০০টাকা) ২০০১সালে মোক্তারের হাতে দিয়ে বলে বাবা এটা দিয়ে তুই শুরু কর!

মায়ের সাথে পরামর্শ করে নিজেই একটি চানাচুরের ফ্যাক্টরি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় উদ্যোক্তা মোক্তার হোসেন শিকদার। ফ্যাক্টরির মালিকের কাছে গিয়ে মালিকের পুরানো উপকরণ সংগ্রহ করে তার যাত্রা শুরু করে। প্রথম প্রথম নিজে ভ্যানে করে চানাচুর সবার দ্বারে দ্বারে পৌঁছাতে থাকেন। তার চানাচুর সবার কাছে খুবই প্রিয় হয়ে ওঠে।

২০০৮ সালে উদ্যোক্তা মোক্তার হোসেন চানাচুর ভাজার জন্য বেশি পরিমানে তেল সংগ্রহ করার কিছুদিনের মধ্যে হঠাৎ ব্যারেল প্রতি ১৩ হাজার টাকা করে বৃদ্ধি পায়। ফলে অন্যান্য চানাচুর ফ্যাক্টরি তেলের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় চানাচুরের দাম বাড়িয়ে দেয়। তখন সবার কেজিতে চানাচুর বিক্রি হোত কিন্তু কোন প্যাকেট দিতো না। মোক্তার হোসেন চিন্তা করলেন চানাচুরের দাম বৃদ্ধির সাথে একটি প্যাকেট দিতে পারলে ক্রেতারা খুশি মনে স্বচ্ছ চানাচুর খেতে পারবে। এবং প্যাকেটের উপরে নাম দিল “আবার খাব চানাচুর”।

এরপর থেকে উদ্যোক্তা মোক্তার হোসেন কে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। দিনে দিনে ব্যবসা বৃদ্ধির ফলে চানাচুরের পাশাপাশি তিনি তৈরি করতে শুরু করেন বিভিন্ন ধরনের খাজা, মিষ্টি মোয়া, চিপস সহ অন্যান্য খাদ্য সামগ্রী।

বর্তমানে উদ্যোক্তার ফ্যাক্টরির মূল্যমান দাড়িয়েছে এক কোটি টাকার ওপরে। গড়ে বাৎসরিক আয় প্রায় ১২/১৩ লক্ষ টাকা। এছাড়াও এই প্রতিষ্ঠান থেকে উপার্জিত অর্থ দিয়ে উদ্যোক্তা নিজের অবস্থার পরিবর্তন করেছেন।

প্রথমে তার পরিবার নিয়ে কাজটি শুরু করলেও বর্তমানে তিনি প্রায় ১৫০ জন পুরুষ ও মহিলার কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন। উদ্যোক্তা মোক্তার হোসেন শিকদার তার কর্মীদের ফ্রী খাবারের ব্যবস্থা রেখেছেন এবং তার জন্য তিনি একটি ঘেরে মাছ চাষের ব্যবস্থা করে রেখেছেন। উদ্যোক্তা মোক্তার হোসেন গরীব ও অসহায় মানুষের পাশে থেকে লেখাপড়া ও অন্যান্য সামাজিক কর্ম কান্ডে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন।

উদ্যোক্তার এই কর্ম নিষ্ঠা উদ্যোগের জন্য তিনি ব্যাংক ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকে সম্মাননা পুরষ্কার পেয়েছেন।

 

কে.এম. সুলতান
গৌরনদী, বরিশাল 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here