নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হতে পারেন উদ্যোক্তা শ্বেতা

0
উদ্যোক্তা তনিমা সিদ্দিকী শ্বেতা

সমাজ এবং মানুষের জন্য কিছু করার তাগিদ অনেক আগে থেকেই ছিল। তাই তনিমা সিদ্দিকী শ্বেতা ঠিক করেন উদ্যোক্তা হিসেবে নয়, মানুষকে সাহায্য করার জন্যই খাঁটি, বিশুদ্ধ গ্রোসারি প্রোডাক্ট নিয়ে কাজ শুরু করবেন। আর করোনা কালীন সময়ে যখন স্কুল কলেজ বন্ধ। চারিদিকে শুধু ডিপ্রেশন, মেন্টাল ট্রমা, আইসোলেটেড থাকা এবং চারিদিকে মানুষের অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা। তখন নিজেকে গুটিয়ে রেখে সময় নষ্ট করতে মোটেই ইচ্ছে হয়নি শ্বেতার। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে উদ্যোক্তা হওয়ায় ভাবনাটা শুরু তখন থেকেই।

অনার্স করার সময় থেকেই কোচিং সেন্টারে শিক্ষকতা করতেন, একটা ছোটো এনজিওতে ইংলিশের প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। আর অনার্স শেষ হতেই, ডেফোডিল ইন্সটিটিউট অফ আইটিতে লেকচারার হিসেবে জব শুরু করেন। সেই সাথে এমবিএ চালিয়ে যান। পড়াশুনা শেষ করে বাংলালিংক, কুয়েত এয়ারলাইনস, সাউথ ইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোতে জব করেন এবং দুর্দান্ত ক্যারিয়ারকে লক্ষ্য করে এগিয়ে যান।

কিন্তু হঠাৎ করেই সবকিছু থেমে যায় বেবি কনসিভ করার কারণে। প্রায় দেড় বছরের একটা লম্বা বিরতি চলে আসে। যার কারণে প্রচণ্ড মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন শ্বেতা। কিন্তু ঘুরে দাঁড়ানোর এক দৃঢ় মনোবল নিয়ে কোনো প্রকার সাপোর্ট ছাড়াই আবারো শুরু করেন। নিজের একটা পরিচয় তৈরি করতেই হবে সেই সাথে সংসার সামলিয়ে বাচ্চাকে লালন পালন করা, সবকিছুতে মানিয়ে নিতে শিক্ষকতাকে বেছে নেন তিনি। নিজেকে প্রতি নিয়ত ট্রেইন আপ করা এবং নতুন কিছুতে গ্রুম আপ করাটা অনেকটা প্যাশনের মতো তার কাছে। তাই সুযোগ পেলেই অনলাইন কিংবা অফলাইনে ব্রিটিশ কাউন্সিলের বিভিন্ন ট্রেনিং-এ অংশ গ্রহন করেন তিনি। কর্মজীবী হিসেবে আছেন প্রায় ১৭/১৮ বছর।

যশোরের মেয়ে শ্বেতা কিন্তু কর্মক্ষেত্র এবং সাংসারিক জীবন ঢাকাতেই কাটে। তাই খুব দীর্ঘ সময় চাইলেও যশোরে থাকা হয়ে ওঠে না। তবে করোনাকালীন সময়ের পুরোটাই যশোরে থাকার একটা বিশাল সুযোগ তৈরি হয়। আশে পাশের মানুষ এবং অনেকেরই কর্মসংস্থান হারানো এবং অর্থনৈতিক ভাবে ভেঙে পড়া এমনকি নিজের হাসবেন্ড এর বিজনেসও অনেকটা বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম, সব মিলিয়ে চিন্তায় পড়ে যান তিনি। কিছু পুঁজি আর সঞ্চয় দিয়েই চলতে হয়েছে করোনার প্রথম দেড় বছর। কিন্তু ওই সময়টা লেখালেখি এবং অন্যান্য ক্রিয়েটিভ কাজ কর্মে ব্যস্ত থাকার প্রয়াস ছিল সর্বোচ্চ। তাই শুরুটা হলো যশোর থেকেই কিন্তু প্রতি মাসে নিয়ম করে মানুষগুলোকে সাহায্য করাটা শ্বেতার জন্য বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। যশোরের ঐতিহ্যগুলোকে কাজে লাগিয়ে কর্মহীন মানুষগুলোর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে শুরু করলেন তিনি। এছাড়াও ভেজাল বিরোধী খাঁটি বিশুদ্ধ পণ্য আরও বিশদ ভাবে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার সুযোগ হবে এবং আরও একটা আইডেন্টিটি তৈরি হবে। যেই ভাবনা সেই কাজ, শুরু করে দিলেন নিজেদের বাগান থেকে সংগ্রহ করা প্রাকৃতিক চাকের মধু আর খেজুরের গুড় দিয়ে।

তারপর ঘানি ভাঙা সরিষার তেল, খাঁটি বিশুদ্ধ ঘি, যশোরের বিখ্যাত নলেন গুড়ের প্যাড়া সন্দেশ, তারপর একে একে গুড়া মশলা, নারিকেল তেল, গমের আটা, চালের আটা, কুমড়ো বড়ি, চুই ঝাল। এরপর তো যশোরের হাতের কাজ, নকশী কাঁথাতো আছেই। তবে বিষয়টি শ্বেতার কাছে গতানুগতিক, একই ধারার মনে হয়েছে। তাই নিজেকে আরেকটু আপ টু ডেট করার জন্য ফ্যাশন ডিজাইনিং-এর কয়েকটি কোর্স এবং কর্মশালায় প্রশিক্ষণ নেন আমাদের দেশের বরেন্য কিছু ব্যক্তিদের কাছ থেকে। যা তাকে অনেক বেশি ইন্সপায়ার করেছে শুধু হাতের কাজ নয়, সাথে দেশীয় কাপড় ব্যবহার করে একটু ভিন্ন আঙ্গিকে কিছুটা ওয়েস্টার্ন, কিছুটা ফিউশন এবং ট্রেন্ড নিয়ে কাজ করতে। যদিও তিনি নতুন কিন্তু উদ্যোক্তা হয়ে এধরণের কাজে মানসিক প্রশান্তিটা অনেক বেশি বলে তিনি মনে করেন।

‘Tehzeeb’s Gallery’ এবং ‘Apparel & More’ নামে দুইটা অনলাইন প্লাটফর্মের মাধ্যমে তিনি তার উদ্যোগ পরিচালনা করছেন। ট্রেড লাইসেন্স করেছেন ‘Tehzeeb’s e-Mart’ নামে। নিজেদের বাগান থেকে সংগ্রহ করাতে প্রথমে পুঁজি বা ইনভেস্ট ছিল খুবই সামান্য মাত্র ৩৫০০ টাকা। আর বড় কোনো ইনভেস্টমেন্ট-এর প্রস্তুতিও ছিল না, ছিল শুধু কাজ করার প্রবল ইচ্ছা। পরিবারের সবার কাছে বিষয়টা ছিল পাগলামীর সমান। বর্তমানে তার কোনো কারখানা নেই তবে যশোরে ৬/৭ জন কর্মী এবং ঢাকাতে ২/৩ জন কর্মী নিয়ে তিনি কাজ করছেন। প্রতিটি পণ্য গড়ে এখন ২৫/৩০ কেজি/লিটার উৎপাদন করতে হয় কখনো তারও বেশি। পোশাকে অর্ডার ভিত্তিক কাজ থাকে মাসে ১৫/২০টি। আর রেডিমেড প্রোডাক্টও থাকে বেশ কিছু। মাসে পণ্য বিক্রি হয় মোটামুটি ৭০/৮০ হাজার টাকা।

গ্রোসারি আইটেমগুলোর চাহিদা মূলত বেশি। তবে খেজুরের পাটালি গুড়ের ডিমান্ড খুব বেশি। বলতে গেলে সিজনে পাটালি গুড়ই মাসে লাখের উপর সেল নিয়ে আসে। সাথে নারিকেল তেল, গুড়া মসলার, সরিষার তেল, ঘি রেগুলার বেসিসে সেল হয়। সরাসরি পণ্য রপ্তানি করা হয়নি। তবে কানাডা, সুইডেন, ইউএসএ, অস্ট্রেলিয়া, লন্ডনে বেশ কিছু ক্রেতা রয়েছেন। যারা নিয়মিতই পণ্য ব্যবহার করেন। এছাড়াও দেশের ভেতর সর্বাধিক অর্ডার ঢাকা, চিটাগং, সিলেট, কুমিল্লা, বরিশাল, নীলফামারী, মৌলভীবাজার, খুলনা,যশোর অন্যতম।

ভবিষ্যত পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে উদ্যোক্তা তনিমা সিদ্দিকী শ্বেতা বলেন, “অনলাইন এবং অফলাইনে আরো বড় পরিসরে একটি দেশীয় পণ্যের ডিপার্টমেন্টাল স্টোর দিতে চাই৷ যা দেশের চাহিদা মিটিয়ে দেশের বাইরেও আমাদের দেশীয় পণ্যকে রিপ্রেজেন্ট করবে এবং তা শুধু যশোর নয়,বাংলাদেশের সব অঞ্চলের পণ্য নিয়েই কাজ হবে।”

বিশিষ্ট ব্যবসায়ী এবং সমাজ সেবক এমএ মতিন সিদ্দিকী-এর বড় মেয়ে শ্বেতা । মা, জাকিয়া সুলতানা যশোর ইন্সটিটিউট-এর একজন স্বনামধন্য শিক্ষিকা। মা-বাবা দু জনই যশোরের স্বনামধন্য দুই রাজনৈতিক পরিবারের সদস্য। ছোটো ভাই প্রথম শ্রেণীর সরকারী কর্মকর্তা। শিক্ষকতার পাশাপাশি উদ্যোক্তাজীবনকে বেশ উপভোগ করছেন শ্বেতা।

সেতু ইসরাত,
উদ্যোক্তা বার্তা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here