চিত্রশিল্পী থেকে একজন উদ্যোক্তা

0
উদ্যোক্তা সেঁজুতি নাসির জুঁই

সেঁজুতি নাসির জুঁই এর গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়ার মেহেরপুরে,কিন্তু তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকাতেই। তিনি পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগে। বাবা নাসির বিশ্বাস ছিলেন একজন চিত্রশিল্পী,আর মা লুৎফা বিশ্বাস ছিলেন গৃহিণী।

ছোটবেলা থেকেই ফ্যাশন বা ড্রেস ডিজাইনের প্রতি সেজুঁতির বরাবরই আকর্ষণ ছিলো। যেহেতু তার বাবাও একজন চিত্রশিল্পী ছিলেন সেই সূত্রেই হয়তো তার মনটাও সে রকমই শিল্পের প্রতি ঝুঁকেছিল,মায়ের ইচ্ছা না থাকলেও বাবার আসকারাতে চারুকলায় পড়েছিলেন বলে জানান সেজুঁতি।

উদ্যোক্তা হবার শুরু প্রসঙ্গে সেজুঁতি বলেন, অনেক আগে থেকেই নিজের জামা নিজে বানানো, সেলাই করা এগুলোর প্রতি আমার প্রচন্ড আকর্ষণ ছিলো। নিজের বানানো ভিন্ন ধরনের ড্রেস পড়তে সব সময়ই আমি পছন্দ করতাম।

চারুকলা থেকে পাশ করার আগেই বিভিন্ন কারণে চাকরিতে ঢুকি। মাস্টার্স করার আগেই নাম করা প্রতিষ্ঠান এশিয়াটিকে জয়েন করি। কিন্তু মনের ভিতরে ড্রেস ডিজাইনের প্রতি আকর্ষণটা থেকেই যায়, একসময় মনে হলো চাকরির পাশাপাশি নিজে কিছু করি, সেই চিন্তা থেকেই আমি আর দুজন মিলে একটা বুটিকসের ব্যবসা শুরু করি সেই থেকেই মূলত উদ্যোক্তা জীবনের শুরু।

বুটিক’স এর ডিজাইন সেকশনটা সেজুঁতি দেখতেন বাকি দুইজন অন্য সেকশন দেখতেন, বসুন্ধরায় আর মিরপুরে তাদের উদ্যোক্তা দুটি শাখা ছিলো। সেজুঁতি জানান, অফিস থেকে এসে আমি কারখানায় যেতাম, ডিজাইন সেকশনটা দেখতাম, কারিগরকে সব বুঝাতাম, রাতে একটা দুইটা পর্যন্ত ওখানে থাকতাম আবার পরের দিন সকালে অফিস করতাম। এতো পরিশ্রম করার পরও কোন রকম কষ্ট মনে হতো না। কাজটা আমার জন্য ভাললাগা ও নেশার মত ছিলো।

কিন্তু সেজুঁতি আক্ষেপের সুরে জানালেন,সবই ভালো চলছিলো, চার পাঁচ বছর হয়ে গেলে বুঝতে পারলাম, আমাদের তিন জনের মধ্যে যে একাউন্ট সেক্টর দেখতো সে আমাদের ঠিকমতো হিসাব দিচ্ছে না কিন্তু আমরা তাকে বিশ্বাস করেছিলাম। এক পর্যায়ে আমরা দুজন বুঝতে পারলাম যে,সে আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করছে, তারপর বুঝলাম এভাবে আর এগিয়ে যাওয়া যাবে না, টাকা যা গেছে যাক কিন্তু সময় ও শ্রম আর ব্যয় করতে চাই না, তাই ওখানেই থেমে যাই।

এরপর আবারও কিছুদিন চাকরি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি কিন্তু নিজের মনের ভিতরে “একান্ত কিছু করার” ইচ্ছাটা থেকেই যায়। এর কিছুদিন পর নিজেই ফেসবুকে একটা পেইজ খুলি, ওখানে টুকটাক ব্যবসা চলছিল। যেহেতু আমি এশিয়াটিকে আর্ট ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করতাম তাই আমাকে চাকরি নিয়ে অনেক ব্যস্ত থাকতে হতো। তাই ঠিক ভাবে নিজের উদ্যোগে সময় দেওয়া, নিজের স্বপ্নটাকে পূরণ করা সম্ভব হচ্ছিলো না। তাই ২০১৮ তে চাকরি ছেড়ে নিজের স্বপ্ন পূরনে মনোনিবেশ করি, নিজের ভালোলাগার দিকে এগিয়ে যাই। অবশেষে পুরোপুরি ভাবে উদ্যোগ শুরু করি।

সেজুঁতি নাসির জুঁই এর পেইজের নাম থৈথৈ। একটু ভিন্ন আঙ্গিকে উদ্যোগ শুরু করেছিলেন তিনি, যেহেতু তিনি একজন চিত্রশিল্পী, ছবি আঁকেন তাই নিজের আঁকা ছবি দিয়ে শাড়ি,ড্রেস করা শুরু করেন। উদ্যোক্তা সেজুঁতি জানান, হ্যান্ড পেইন্ট তো অনেকেই করে কিন্তু আমি ভাবে দেখলাম হ্যান্ড পেইন্ট না করে আমার আঁকা ছবিগুলো দিয়ে ডিজাইন করে তারপর ডিজিটাল প্রিন্ট করাবো তাতে হ্যান্ড পেইন্টের মজাটাও পাওয়া যাবে আবার খুব তাড়াতাড়ি বহু সংখ্যক পন্য বানানো যাবে এবং একটু কম প্রাইজেও দেওয়া যাবে। এরপর শুরু হলো আমার এক্সপেরিমেন্টাল যাত্রা। কাগজে ছবি আঁকি তারপর ওটা স্ক্যান করে কম্পিউটারে নিয়ে নেই তারপর কম্পোজিশন করে ডিজাইন করি শাড়ি বা কামিজের উপর, তারপর সেগুলো প্রিন্ট করাই।

ব্যাপারটা এভাবেই চলছিল হঠাৎ করে সেজুঁতির দুই বান্ধবী আগ্রহ প্রকাশ করে তাকে জানালেন, তারাও তার সাথে থাকতে চান,যদিও তার ইচ্ছা ছিল না আর যৌথ ভাবে কাজ করার, তবুও বান্ধবী বলে হয়তো বিশ্বাসটা আসলো। তবে তিনি জানান আমার থৈ থৈ পেইজটা আমি আলাদাই রেখেছি,যা আমার নিজস্ব। পাশাপাশি “কারুশ্রী” নামে আর একটা পেইজ সেখানে আমি আমার দুই বান্ধবী শিখা ও কাকলিকে সংঙ্গে নিয়ে এগিয়ে চলছি। আমাদের এই যাত্রায় ভালো সাড়া পাচ্ছি, অনলাইনেই পণ্য বিক্রি করছি। এছাড়া তাদের পণ্যের পরিচিতি ও প্রচার প্রসার বাড়ানোর লক্ষ্যে তারা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মেলায়ও অংশগ্রহণ করছেন, জানান উদ্যোক্তা সেজুঁতি।

সেজুঁতি জানান, প্রথমে শুরুতে প্রায় এক লাখ টাকার পুঁজি দিয়ে উদ্যোগ শুরু করেছিলাম। এখন প্রতিমাসে ৩০ হাজার টাকার মতো সেল হয়। আমার নিজস্ব কোন কর্মী নেই তবে পরোক্ষভাবে বহু মানুষের সাথে আমি কাজ করি। নিজের ডিজাইন শাড়ি,কামিজের নকশা বা প্রিন্টের উপর কিছু নারী কর্মী আছেন যারা কাঁথা স্টিচ করে দেন তাতে সেটায় আরো একটু ভিন্নতা আসে। তার প্রতিষ্ঠানে রয়েছে ডিজিটাল প্রিন্টের, হ্যান্ড পেইন্টের সুতি শাড়ি,মসলিন শাড়ি,কামিজ, কুর্তি,বেড কভার, কুশন কভার,শাল সহ নানা পণ্য।

তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য উদ্যোক্তা সেজুঁতি বলেন, জীবনের চলার পথটা অতোটা সহজ নয়, যদিও সামনে তাকালে মনে হয় রাস্তাটা সোজাই আছে, হেঁটে যেতে পারবো কিন্তু সামনে এগোতে গেলে শত বাধা আমাদেরকে ঘিরে ধরে কিন্তু তাই বলে থেমে গেলে হবে না, সেই বাধা অতিক্রম করে সামনে এগিয়ে যেতে হবে, হয়তো সে ক্ষেত্রে চলার গতি কিছুটা কমে হবে কিন্তু তবুও গন্তব্যে ঠিকই পৌঁছানো যাবে বলে তিনি মনে করেন।

ভবিষ্যত পরিকল্পনা নিয়ে উদ্যোক্তা সেজুঁতি বলেন, যখন দেখি আমার ডিজাইন করা শাড়ি বা ড্রেস মানুষ আনন্দের সাথে পড়ছে ঠিক তখনই নিজের কাজকে সার্থক মনে হয়। ভবিষ্যতে নিজের একটা শো রুম দেবার ইচ্ছা আছে, যেখান থেকে মানুষ খুব সহজেই আমার ডিজাইনের পণ্য পাবে।

আফসানা অভি
উদ্যোক্তা বার্তা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here