চাকরি ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন একসময়, আজ সফল উদ্যোক্তা রাখি

0
উদ্যোক্তা রাহিয়াতুল জান্নাত রাখি

ব্যাপক চাহিদা থাকার পরও বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে মসলিন। যে কার্পাস ফুল থেকে মসলিনের সুতা পাওয়া যায়, সেই ফুটি কার্পাসের ফলন বাড়াতে ব্যস্ত সময় পার করছেন উদ্ভিদবিদরা। পাশাপাশি মসলিনের শাড়ি ও পোশাক ফিরিয়ে আনার জন্য কাজ করছেন দেশীয় পণ্যের অনেক উদ্যোক্তাও। তাদের মধ্যে একজন তরুণ উদ্যোক্তা রাহিয়াতুল জান্নাত রাখি। তার প্রতিষ্ঠানের নাম Girly Boutique।

রাখি বলেন, নতুন প্রজন্মের অনেকেই এখন হারিয়ে যাওয়া শিল্প শেখার চেষ্টা করছে। তাদের মধ্যে আমি একজন। এর জন্য অবশ্য শক্ত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হচ্ছে। কারণ উদ্ভিদের অতি-সূক্ষ্ম সুতা বুনতে যথেষ্ট দক্ষ তাঁতি খুঁজে পাওয়া সহজ নয়। তাও চেষ্টা করছি হারিয়ে যাওয়া মসলিনের ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনার। এর জন্যই এই উদ্যোগ নিয়ে আমার উদ্যোক্তা হিসেবে পেশা বেছে নেওয়া।

উদ্যোক্তা রাহিয়াতুল জান্নাত রাখি বেড়ে উঠেছেন সিরাজগঞ্জ সদরে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূতত্ত্ব ও খনি বিদ্যা বিভাগে মাস্টার্স করে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারি শিক্ষক হিসেবে ৭ বছর চাকরি করেন। কিন্তু পারিবারিক সমস্যার কারণে চাকরি ছাড়তে বাধ্য হন। এরপর শুরু হয় উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্যোগ

রাখি উদ্যোক্তা বার্তাকে বলেন, ‘আমার স্বামী যখন আমাকে চাকরি ছাড়তে বলে তখন একরকম বাধ্য হয়েই চাকরি ছেড়েছিলাম। তখন আমার মেয়ের বয়স এক বছর। ঢাকায় এলাম, কিন্তু আমার স্বামী সুবিধা করতে পারছিলেন না। আমি আবার সিরাজগঞ্জ ফিরলাম। সিরাজগঞ্জ যাবার আগে আমার (শারমিন আফরোজ সুমি) চাচাতো বোন আমাকে পরামর্শ দেন বসে না থেকে কিছু একটা করার। চিন্তা ভাবনা করে ৫,০০০ টাকার ব্লক ও রং যা লাগে সেই বোন কিনে দিল। চলে গেলাম সিরাজগঞ্জ। সেখানকার তাঁতিদের কাজে লাগালাম। তাঁতের সাধারণ কাপড়কে হ্যান্ডপেইন্ট, ব্লক এবং হাতের সেলাই দিয়ে অসাধারণ পোশাক বানিয়ে ফেলতাম। আমার তৈরি জামা ফ্রেমে আটকানো অর্ধেক কাজ অবস্থায়ও বিক্রি হয়ে যেতো। এভাবে উদ্যোক্তা হওয়ার যাত্রা শুরু হয়। তখন আমি পাশাপাশি বিএড কলেজেও চাকরি করি।’

রাহিয়াতুল জান্নাত রাখি জানান, মসলিনের প্রতি ছোটবেলা থেকে আকর্ষণ কাজ করতো। সেই সময় থেকে মসলিনের পোশাক পরতে ভালো লাগা কাজ করতো। কিন্তু তিনি দেখলেন যে ধীরে ধীরে মসলিন শাড়ি ও পোশাক কেমন যেন হারিয়ে যাচ্ছে। সেই থেকে তাঁতের ব্লক, প্রিন্ট এর পণ্য নিয়ে শুরু করেন। তার শখের পণ্য মসলিনের পোশাক নিয়ে কাজ করার স্বপ্ন বুনেন। যদিও মসলিনের পণ্য নিয়ে কাজ করার সিদ্ধান্ত তখনও নিতে পারছিলেন না। এরপর ২০২০ সালের স্বামীর সাথে পরামর্শ করে ৫০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করে কিছু ইন্ডিয়ান পণ্যের ব্যবসা শুরু করেছিলেন। কিন্তু সেই পণ্যগুলো বিক্রি করতে পারেননি। কিছুদিন পর ব্যবসা পুরোপুরি বন্ধ করে দিতে হয়।

এরপর সিরাজগঞ্জ থেকে পারিবারিক কাজের জন্য ঢাকায় আবার ফিরে আসতে হয়। কিন্তু ব্যবসা বন্ধ হওয়ার কারণে কিছু করতে পারছিলেন না। একদিন চাচাতো বোনের বাসায় বেড়াতে যান। সে জিজ্ঞেস করে আপু তুমি কী করছ? ‘আমি কোন উত্তর দিতে পারিনি। সে বুঝতে পারে আমি কিছুই করতে পারছি না। সে আমাকে পরামর্শ দেয় মাসে তিনটি ড্রেস বানাও কিন্তু সেটা ইউনিক হতে হবে। পরদিন সে নিজ থেকে ২০ হাজার টাকা পাঠায়। আবার কাজ শুরু করি। যোগ হয়ে যাই উই গ্রুপের সাথে, সেখানে আমার পরিকল্পনা করা ব্যবসা অর্থাৎ মসলিনের পণ্য নিয়ে অনেকেই কাজ করছেন। তা দেখেই আমি সাহস ও অনুপ্রেরণা পাই। আর মসলিন নিয়ে কাজ করার উদ্যোগ শুরু করে দেই। ধীরে ধীরে মসলিনে ড্রেস,শাড়ির উপর ডিজাইন করে বানানো শুরু করি। এক্ষেত্রে আমার এমব্রয়ডারি দক্ষ কারিগরের অবদান অসামান্য। শুরু হয় আমার মসলিনের ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ। ‘

মূলত ২০২০ এ বোনের দেওয়া ২০ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে অনলাইন ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান Girly Boutique এর মাধ্যমে উদ্যোক্তা রাখি কাজ শুরু করেন। প্রথমে মসলিনের কিছু পণ্য নিয়ে কাজ করলেও বর্তমানে মসলিন শাড়ি, মসলিন ড্রেস,মেয়েদের কাস্টমাইজ ড্রেসের ব্যবসা করছেন। তার কর্মী রয়েছেন আট জন। প্রচার ও প্রসারের জন্য বেশিরভাগ মেলায় অংশগ্রহণ করেন। মাসে গড়ে ২০,০০০ টাকা সেল হয় তার। এ পর্যন্ত পরিচিত মানুষের মাধ্যমে আড়াই লক্ষ টাকার পণ্য আমেরিকাতে পাঠিয়েছেন। আর ৪টি মসলিনের ড্রেস গেছে কানাডায়। দেশের ভেতর ঢাকা, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া গেছে উদ্যোক্তার পণ্য।

তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে নিজের পণ্যের ব্র্যান্ডিং করা এবং আরো বড় পরিসরে মেয়েদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা।

তিনি বলেন, মসলিন আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের অহংকার। আমাদের জাতিসত্তার একটি অংশ। সঠিক পৃষ্ঠপোষকতা আর প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকলে নিশ্চয়ই মসলিন একদিন তার হারানো ঐতিহ্য ফিরে পাবে । সেদিন হয়তো মসলিন দিয়েই বাংলাদেশকে আবার নতুন করে চিনবে বিশ্ব।

এমনই স্বপ্ন দেখেন উদ্যোক্তা রাহিয়াতুল জান্নাত রাখি।

মেহনাজ খান
উদ্যোক্তা বার্তা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here