গামছা ফিউশনে নতুন আলোড়ন সৃষ্টিকারী উদ্যোক্তা রোকেয়া

0

বাবা-মায়ের বিচ্ছেদের জেরে উচ্চমাধ্যমিক প্রথম বর্ষেই সংসারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন রোকেয়া আক্তার। পরিবারের প্রয়োজন মেটাতে এতো অল্প বয়সেই পা দেন চাকুরি জীবনে। মাত্র ১৫০০ টাকা বেতনে প্রথম চাকরি নেন মেট লাইফ এলিকো কোম্পানিতে। কিন্তু স্বজনপ্রীতির কারণে তাকে বেতন না দিয়েই চাকরি থেকে ছাঁটাই করা হয়। তারপর যশোরের কুইন্স হসপিটালে ১৭০০ টাকা থেকে শুরু করে ৩৭০০ টাকা পর্যন্ত বেতনে চার বছর কর্মরত ছিলেন। এরপর ‘বিবর্তন’ নামের একটি ফ্যাশন হাউজের শোরুমে দুই বছর কর্মরত ছিলেন।

কোনো মতে টেনেটুনে ভালোই চলছিলো সংসার। হঠাৎ একদিন থ্যালাসেমিয়া নামক জটিল রোগে আক্রান্ত হলেন রোকেয়া। আকষ্মিক ভাবে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ায় তার আর চাকরি কন্টিনিউ করা সম্ভব হয়নি। দীর্ঘ একবছর অসুস্থতার কারণে তিনি কোনো টাকা উপার্জন করতে পারেননি। যেহেতু তিনি ছিলেন তার পরিবারের প্রধান আর্নিং মেম্বার। পরিবারের জন্য সে সময়টা অনেক বেশি টানাপড়েনে কাটে। জীবনটা হয়ে ওঠে দূর্বিষহ।

কিছুটা সুস্থ্য হওয়ার পর পুনরায় জবের চেষ্টা করেন কিন্তু অতি অসুস্থতায় স্বাস্থ্য ভঙ্গ হওয়ায় যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও, লুকের জন্য সব জায়গা থেকে ব্যর্থ হয়ে ফিরতে হয়। কিন্তু টিকে থাকতে হলে তাকে আয়তো করতেই হবে। অতঃপর এক পরিচিত আপুর মাধ্যমে শুরু করেন হাতের সেলাই এবং হ্যান্ড পেইন্টিং-এর কাজ। উনি অর্ডারগুলি এনে দিতেন, তখনও নিজের কোন পেইজ ছিলো না উদ্যোক্তা রোকেয়ার। দীর্ঘদিন পর তার নিজের ভিতর ভাবনা আসলো, ‘আমি ৮-৯ বছর ধরে পরিশ্রম করছি কিন্তু কোথাও আজও নিজের আইডেন্টিটি গড়তে পারিনি। নিজের ট্যালেন্ট আছে কিন্তু সেটা প্রকাশ হচ্ছে না’। সেই নিজের পরিচিতি গড়ার লক্ষ্যে শুরু করেন নিজের উদ্যোগ।

সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন গতবছর, এবার নিজের পরিচিতি গড়ার পালা। মাত্র চারটা শাড়ি নিয়ে শুরু হয় উদ্যোক্তা জীবনের পথ চলা। একটু একটু করে জমানো মাত্র দশহাজার টাকা পুঁজি নিয়ে শুরু করা উদ্যোগ ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে থাকে। উদ্যোক্তা কাজ করছেন তার নিজস্ব ডিজাইনের হাতের সেলাই ও হ্যান্ড পেইন্টিং নিয়ে। তার সিগনেচার পণ্য ‘গামছা ফিউশন’।

উদ্যোক্তা রোকেয়া তার উদ্যোগের নাম দিয়েছেন ‘চারুকৃৎ’। এই নামে অনলাইনে তার একটি পেজ আছে। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডাতে তার পণ্য গিয়েছে তিন বার। এছাড়া দেশের প্রায় সব জেলাতেই তার পণ্য পৌঁছেছে। তার উদ্যোগে তিনজন তাকে সাহায্য করছেন। তারা নিজেরাই ডিজাইন করেন, পণ্য উৎপাদন করেন। বর্তমানে তিনি মাসে পঞ্চাশ হাজার টাকার পণ্য বিক্রি করেন।

উদ্যোক্তা রোকেয়ার উৎপাদিত গামছা ফিউশন তার উদ্যোগের সাফল্যের উৎস। বাংলাদেশ হাইটেকপার্ক কর্তৃক আয়োজিত, স্টার্টআপ আইডিয়া পিচিং যশোর চাপটারের প্রতিযোগিতায় বারো জন জয়ীর ভিতর একমাত্র ক্লথিং আইটেম নিয়ে বিজয়ী তিনি। যশোর শেখ হাসিনা সফটওয়্যার এবং ট্যাকনোলজি পার্কে স্পেস বরাদ্দ পেয়েছেন। আইডিয়া বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত ১০০ উদ্যোক্তার গল্পে তার নিজের গামছা ফিউশন নিয়েও লেখা প্রকাশিত হয়েছে।

গামছা ফিউশনই তার উদ্যোগের প্রধান ফোকাস। একটি সাধারণ গামছাকেও অসাধারণ কিছুতে পরিণত করা যায়, যদি তাকে সেইভাবে প্রাধান্য দিয়ে কাজ করা যায়। উদ্যোক্তা তার গামছা ফিউশন দিয়ে সবাইকে মেসেজ দিতে চান, সাধারণ কিছুই সবসময় অসাধারণ কিছুতে পরিণত হয়, যদি তাকে সঠিক মূল্যায়ন করা হয়। তাই বাহ্যিক রূপ না দেখে, তার ট্যালেন্ট বা সে কি করতে চাই; সেই সম্ভাবনা থেকে মূল্যায়ন করা উচিত সবাইকে।

উদ্যোক্তার স্বপ্ন তার উদ্যোগ দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিতেও সুপরিচিতি পাবে। তার উদ্যোগের মধ্য দিয়ে বিলুপ্তপ্রায় গামছা তাতীরা পুনরায় সুদিন দেখবেন। এছাড়া তিনি তার উদ্যোগ দিয়ে আরো অনেককে সাবলম্বী করতে চান।

উদ্যোক্তা রোকেয়ার বাবা সিলেট থাকেন। ওখানে একটি ব্যাবসার সাথে যুক্ত আছেন। মা ফরিদপুর রাজবাড়ির মেয়ে। সম্প্রতি একটি হোমমেইড ফুড বিজনেস শুরু করেছেন। চার বোনের বড় রোকেয়া। গ্রামের বাড়ি মনিরামপুর থানার খেদাপাড়া গ্রামে ।ছোটবেলা থেকে বেড়ে ওঠা এবং স্কুলের একাংশ কেটেছে সিলেটে। আকষ্মিক পারিবারিক দূর্ঘটনার জন্য যশোরে গ্রামের বাড়িতে চলে আসা। গ্রামেরই স্কুল খেদাপাড়া পল্লীমঙ্গল মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, যশোরের হামিদপুর মহাবিদ্যালয় থেকে এইসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। এরপর যশোর সরকারি সিটি কলেজ থেকে উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন। অদম্য সাহসী উদ্যোক্তা রোকেয়া। বর্তমানে তিনি উই-এর যশোর জেলার সহ-প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

সাইদ হাফিজ
উদ্যোক্তা বার্তা
, খুলনা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here