উদ্যোক্তা- হাসিনা মুক্তা

মার্চের প্রথম দিকের কথা। বহির্বিশ্বে হলেও বাংলাদেশে তখনও করোনার প্রাদুর্ভাব তেমন একটা দেখা দেয়নি। কিন্তু তারপরও কর্মী, স্টাফদের সুরক্ষার জন্য মাস্ক কিনতে গিয়ে উদ্যোক্তা হাসিনা মুক্তা দেখেন মাস্কের অসাভাবিক দাম ২০ টাকার মাস্কের দাম ৮০ টাকা। খারাপ লাগা কাজ করে ব্যবসায়ীদের এমন মানসিকতা দেখে।

তাই একটা মাস্ক কিনে আনেন এবং যেহেতু তিনি পোশাক নিয়েই কাজ করেন তাই নিজেই তৈরীর চেষ্টা করলেন। উদ্দেশ্য একটাই, সঠিক মূল্যে ক্রেতাদের হাতে পৌঁছানো, দেশের ক্রান্তিলগ্নে কিছুটা এগিয়ে আসা আর অধিক মুনাফা লোভী সুযোগসন্ধানী ব্যবসায়ীদের কিছু বোঝানো। উদ্যোক্তার ফ্যাক্টরিতে তখন বৈশাখের কাজ চলছিলো। সেটা বন্ধ করে মাস্ক বানানো শুরু। ২০টাকায় ক্রেতার হাতে মাস্ক তুলে দিতে সক্ষম হলেন আর যারা ফ্রী বিতরণের জন্য নিবেন তাঁদের জন্য ১৬টাকা।

অনলাইন পেইজে বিপুল সাড়া পেলেন উদ্যোক্তা হাসিনা মুক্তা। তিনি বলেন, “প্রথম থেকেই আমার উদ্দেশ্য ছিলো মাস্কের প্রকৃত ব্যবসায়ীরা যদি মাস্কের দাম কমায় তবে আমি মাস্ক বানানো বন্ধ করবো। আরও কয়েকজন উদ্যোক্তাকে এ বিষয়টি বুঝিয়ে বললাম এবং উৎসাহিত করলাম। তাদেরকেও কাঁচামাল পেতে সহযোগিতা করলাম। এতো বেশি অর্ডার আসছিলো যা আমি একা তৈরি করে শেষ করতে পারছিলাম না। তারপর একটা সময় দেখলাম মাস্ক ব্যবসায়ীরাও মাস্কের দাম কমিয়ে ৪০টাকায় বিক্রি শুরু করে। ঠিক এমন সময় বাংলাদেশেও করোনা ভাইরাসের লক্ষণ দেখা যায়। বিভিন্ন মিডিয়াতে দেখতে পেলাম করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের যে ডাক্তাররা চিকিৎসা দিবে তাঁদের পর্যাপ্ত পিপিই নাই। এবং সরকারী ভাবে যেগুলো আসার কথা সেসব পিপিই আসতেও কিছু সময় লাগবে। বিষয়টা তখন আমাকে ভাবায়”।

ডাক্তারদেরই যদি নিরাপত্তা না থাকে তাহলে তারা কি করে রোগীদের চিকিৎসা দিবেন? আমাদের দেশের গার্মেন্টসগুলোও এ বিষয়ে কোন উদ্যোগ নিচ্ছে না। তখন উদ্যোক্তা হাসিনা মুক্তা নিজ দ্বায়িত্ববোধ থেকে চেষ্টা করেন পিপিই তৈরি করার। পিপিই নিয়ে একটু পড়াশোনা করলেন গুগোল, ইউটিউব করে জানলেন কি ধরণের ফেব্রিক, প্যাটার্ন , মেজারমেন্ট কি হওয়া দরকার। ভাইরাস ভেদ করে যেতে না পারে তার জন্য কি কি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে এবং সে অনুযায়ী ফেব্রিক ও অন্যান্য এক্সেসরিজ কিনে প্রথমে স্যাম্পল এবং পরে প্যাটার্নও তৈরি করলেন।

কিন্তু পর্যাপ্ত পরিমাণে পিপিই তৈরি করার মতো অর্থ না থাকায় ফেসবুকে একটা পোস্ট দেন যে তার মাধ্যমে যে কেউ পিপিই তৈরী করে নিতে পারেন অথবা তার কারখানা কাজে লাগিয়ে দেশের এই পরিস্থিতিতে অবদান রাখতে পারেন। অনেকেই উৎসাহিত হন তারমধ্যে উদ্যোক্তা তাসলিমা মিজি বিভিন্ন ডাক্তারদের সাথে তাকে যোগাযোগ করিয়ে দেন। যারা ব্যক্তিগত ভাবে এসব পিপিই নিতে চাচ্ছিলেন। প্রথমেই একজন ডাক্তার ১০পিস সুরক্ষা পোশাক/পিপিই ও মাস্ক নেন। উনি হাতে পাওয়ার পর প্রোডাক্টি খুবই পছন্দ করেন এবং সাথে সাথে আরও ২০পিসের অর্ডার দেন। তারপর নানা দিক থেকে ডাক্তার, সেচ্ছাসেবকরা যোগাযোগ করতে থাকেন কেউ ২০ পিস, কেউ ৫০ পিস, কেউ ১০০-২০০ পিস। একা তৈরী করতে হিমসিম খেয়ে বিভিন্ন পোশাক তৈরির উদ্যোক্তাদের আহ্বান জানান এগিয়ে আসার জন্য।

এরই মাঝে ডাঃ সানজিদা ঢাকা মেডিকেলের সার্জারী ডাক্তারদের জন্য ৬০পিস পিপিই অর্ডার করেন। উনি সময়মত পণ্য হাতে পাওয়া এবং পণ্যের মানে সন্তুষ্ট হয়ে আরও নিতে চান। তারপর থেকে হাজার হাজার পিসের অর্ডার আসছে কিন্তু হাসিনা মুক্তা সেগুলো একা তৈরী করতে পারছেন না। কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, “সেসব বড় অর্ডার নেয়ার মতো ক্যাপাসিটি আমার নেই। এ কাজ আসলে আমার করার কথা ছিলো না। যেখানে বাংলাদেশের গার্মেন্টস এসব পণ্য বিদেশে রপ্তানি করে, সেখানেতো এই সময়ে আরও আগেই সে সব গার্মেন্টস মালিকদের এগিয়ে আসা দরকার ছিলো। পিপিই তৈরি করার জন্য যেসব নিয়ম কানুন মানা দরকার এবং অল্প সময়ে প্রয়োজন অনুযায়ী তৈরি করার ক্যাপাসিটি বড় বড় গার্মেন্টসগুলোরই আছে। যাই হোক এখন কিছু কিছু গার্মেন্টস এগিয়ে আসছে, আশা করি সামনে আরও এগিয়ে আসবে। যাদের কাজ তারাই করবে। এ সংকট আর থাকবে না। আমি শুধু দেশের এই ক্রান্তিকালে আমার ক্ষুদ্র প্রয়াসটুকুই দেশের জন্য দেয়ার চেষ্টা করেছি, আর কিছু নয়”।

উদ্যোক্তা হাসিনা মুক্তা বিশাল এই অর্ডার সম্পন্ন করতে না পারলেও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন এবং তার আহবানে এছাড়াও নিজ ইচ্ছায় আরও অনেক উদ্যোক্তা এগিয়ে এসেছেন, তারাও নিজ ফ্যাক্টরিতে পিপিই তৈরী করছেন। অর্ডার ডেলিভারির পাশাপাশি দানও করছেন। দেশের এই পরিস্থিতিতে উদ্যোক্তাদের এমন ভূমিকা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার।

বিপ্লব আহসান

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here