সারাদিনের কাজ শেষে ক্লান্ত শরীর নিয়ে হোটেলের মেঝেতে শুয়ে শুয়ে ছোট্ট ছেলেটি ভাবত, একদিন আমারও অনেক বড় সুন্দর একটা হোটেল থাকবে। যে হোটেলে কাস্টমারদের থাকবেনা কোন অভিযোগ। সকল ধরনের সুবিধাই তারা পাবে। আমার সঙ্গে মালিক যে ব্যবহার করতেন আমি আমার কর্মীদের সাথে তেমন ব্যবহার করবো না আমাদের সম্পর্ক হবে বন্ধুর মতো। কিন্তু পরক্ষণেই বিচলিত হয়ে হেসে ভাবতেন আমার কাছে তো একটি টেবিল, চেয়ার কেনারও টাকা নেই, সেই আমি কিভাবে হোটেলের মালিক হব! কথা গুলো বলে আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন সাহাব উদ্দিন।
হ্যাঁ, তার সেই স্বপ্নটি পূর্ণ হয়েছে। তার সেই উদ্যোগটি গড়ে তুলেছেন করতোয়া নদীর তীরে। হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমানার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের শেষ প্রান্তে প্রাকৃতিক সৌর্ন্দযের লীলাভূমি পঞ্চগড় জেলা। সেই পঞ্চগড়ের জিরো পয়েন্টের আগেই ধাক্কা-মারা মোড় থেকে ডানে কয়েক কদম এগিয়ে গেলেই চোখে পড়বে সেই খাবার হোটেল। নদীর নামানুসারে যার নামকরণ করা হয় ‘করতোয়া’। খুব সুন্দর ছিমছাম ভাবে সাজানো সেই হোটেলটির স্বত্বাধিকারী মোঃ সাহাব উদ্দিন।
উদ্যোক্তা বার্তা টিম গিয়েছিল সরাসরি তার উদ্যোগ পরিদর্শনে। কথা প্রসঙ্গে জানা গেল তার উদ্যোগের গোড়ার কথা। তার এই উদ্যোগের স্বপ্ন বীজ মনে বপন করেছিলেন ছেলেবেলায়। যা সফল হয় আজ থেকে ১৩ বছর আগে। শুরুতে তিনি একটি হোটেলে কাজ করতেন এবং সেখান থেকেই তীব্র ইচ্ছে জন্মে এই উদ্যোগের। বড় হওয়ার পর ১৯৮৮ সালে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তার স্ত্রী এবং তিনি নিজে হোটেলসহ বিভিন্ন জায়গায় কাজ করতেন এবং এভাবে বেশ কিছু দিন যাবার পর তার মায়ের কাছ থেকে তিনশত টাকা নিয়ে শুরু করেন চা বিস্কুটের দোকান। পুরোটা সময় জুড়ে সেই দোকানেই সময় দিতেন। ভালোই বিক্রি হতো। কিছু দিনের মধ্যে সেখানে যোগ হলো দুপুরের খাবার, ভাতের হোটেল। যেখানে নিম্নবিত্তরা দু’বেলা দু’মুঠো তৃপ্তি সহকারে খেতে পারবেন। তিনি পণ করেছিলেন, সফল না হলে বাড়ি ফিরবেন না। প্রয়োজনে চলে যাবেন অন্য জেলায়। কিন্তু না, তাকে আর অন্য জেলায় যেতে হয়নি। সফলভাবে চালিয়ে গেছেন এবং এগিয়ে নিয়েছেন তার উদ্যোগ।
সুপ্ত সেই ইচ্ছের পাখা মেলার সময় যেন এখন। খুব সুন্দর সাজানো-গোছানো একটি বড় পরিসরে হোটেল। কিন্তু কি নাম দেয়া যায়। ভাবতে গিয়ে হঠাৎ তার মনে পরে তার এবং অত্র এলাকার প্রিয় একটি নামকরা হোটেল ছিলো যার মালিক কয়েক বছর আগে পরলোকগমন করেছেন। তিনি সনাতন ধর্মাবলম্বী হওয়ায় গো-মাংস বেচতেন না। তার আদর্শ এবং ভালবাসা থেকেই সেই বন্ধ হওয়া হোটেলের নামেই নামকরণ করেন ‘করতোয়া’।
অন্য ধর্মের বন্ধুর প্রতি সম্মানবোধ থেকেই তিনি এই উদ্যোগটি এখনও অব্যাহত রেখেছেন। যেন সনাতন ধর্মাবলম্বীর মানুষজন নির্দ্বিধায় খেতে পারে। ভারত থেকে অনেকেই কাজের জন্য সেখানে আসতেন এছাড়াও এলাকার অনেক উঁচু বংশীয় সনাতন ধর্মাবলীর মানুষজন আসে সেখানে। পাশাপাশি সর্বসাধারণরা আসে ভেজালবিহীন টাটকা খাবারের জন্য। মজার ব্যাপার হোটেলের প্রতিটি খাবার তৈরি করেন তার স্ত্রী এবং নিজে হাতে তিনি সেগুলো পরিষ্কার এবং রান্নার কাজ গুলো করেন। শুধু মাত্র খাবারের মান ভালো করার জন্য অন্য কর্মীরা কাটাকুটি করলেও সাহাব উদ্দিন এবং তার স্ত্রী রান্নার দ্বায়িত্ব পালন করেন।
সব মিলিয়ে তার প্রতিষ্ঠানে ২০ থেকে ২৫ জন কাজ করেন। সকল প্রকার ভর্তা, সবজি, মাছ, মাংস, টাটকা খাবার, সকালের নাস্তা, দুপুরের খাবার, রাতের খাবারসহ যাবতীয় অনুষ্ঠানের খাবার সরবরাহ করা হয় অর্ডারের ভিত্তিতে। এই উদ্যোগের পাশাপাশি ধীরে ধীরে তার ব্যবসা বেড়েছে। তিনি বাগান করেছেন, বেশকিছু পরিবহন করেছেন এবং পঞ্চগড় স্টেশনের কাছে একটি মার্কেট করেছেন।
অনেক হতাশাগ্রস্থ তরুণদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘অনেকেই আছে যারা কি করবেন ভেবে কুল পাচ্ছেন না, তাদের জন্য আমার পরামর্শ। পরিশ্রম করতে হবে এবং জমানো টাকা কোনোভাবেই নষ্ট করা যাবে না। বেশিরভাগ যুবক তারা কোন না কোন ভাবে উপার্জন করে কিন্তু টাকা গুলো নষ্ট করে যেটা আমি করিনি কখনো আর এ কারণে আজ আমি আমার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পেরেছি’।
তার সততা, একাগ্রতা দেখে বাংলাদেশের সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান তাকে ডেকে পাঠান। সাহাব উদ্দিন এবং তার স্ত্রীর ইন্টারভিউ নেন। বিভিন্ন মিডিয়াতে তার উদ্যোগ নিয়ে লিখা হয়েছে বলেও তিনি জানান। ব্যক্তিগত জীবনে সফল উদ্যোক্তা সাহাব উদ্দিন তিন সন্তানের জনক। আদি নিবাস নোয়াখালী হলেও তার পূর্বপুরুষরা চলে আসেন পঞ্চগড় এবং সেখানেই করতোয়া নদীর বুকে গড়ে তোলেন তাঁর স্বপ্নের ‘করতোয়া’।
বিপ্লব আহসান