এক উদ্যোগেই দিনে ১৫ মেট্রিক টন জৈব সার উৎপাদন

0
উদ্যোক্তা হাছিনা ইয়াসমিন

জৈব সার ব্যবহারে মাটির উর্বরতা বাড়ে। এতে ফসলের প্রধান খাদ্য নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাসিয়াম ও অন্যান্য খাদ্য উপাদান থাকে। ফলে অণুখাদ্যের ঘাটতিও পূরণ হয়। মাটির গঠন ও গুণাগুণ উন্নত করে। বেলে মাটি সরস হয়, পানি ধারণ ক্ষমতা বাড়ে, তাছাড়া এঁটেল মাটিকে কিছুটা দো-আঁশ ভাবাপন্ন করে ফসল জন্মানোর অধিক উপযোগী করে তোলে। এই প্রয়োজনীয় সার উৎপাদন করছে উদ্যোক্তা হাছিনা ইয়াসমিনের ‘হাছিনা এগ্রো এন্টারপ্রাইজ

গোবর, সুগারমিলের প্রেসমার্ট, হাঁস-মুরগির বিষ্ঠা, সিটি কর্পোরেশনের সবজি আবর্জনা ইত্যাদি উপাদান থেকে হাছিনা এগ্রো এন্টারপ্রাইজ দৈনিক ১৫ মেট্রিক টন জৈব সার উৎপাদন করছে। দেশের স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান ব্র্যাক এবং মেসার্স রাশ এগ্রো এন্টারপ্রাইজ এই প্রতিষ্ঠান থেকে জৈব সার নিচ্ছে। গতবার রাশের মাধ্যমে হাছিনা এগ্রো থেকে ৩০০ মেট্রিক টন জৈব সার নিয়ে ভালো ফলাফল পাওয়ায় ব্র্যাক এই বছর অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত দুই হাজার মেট্রিক টন জৈব সারের অর্ডার দিয়েছে। রাশের মাধ্যমে পণ্য নিয়ে থাকে ব্র্যাক। এছাড়াও রাশ নিজেদের জন্য প্রতিমাসে হাছিনা এগ্রো থেকে ১০০ মেট্রিক  টন জৈব সার নিয়ে থাকে। আর হাছিনা এগ্রো রাশ থেকে তাদের উৎপাদিত টাইকোডার্মা ক্রয় করে থাকে বলে জানিয়েছেন উদ্যোক্তা হাছিনা ইয়াসমিন। এছাড়াও এম আর সি ব্র্যান্ডের প্রোডাক্ট তারা বাজারজাত করে।

তিনি উদ্যোক্তা বার্তাকে বলেন: আমার তখন ২২ বছর বয়স। পাঁচ ও আড়াই বছর বয়সী দুটি কন্যাসন্তান রেখে আমার স্বামী সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। আমি সন্তানদের নিয়ে শশুরবাড়িতেই থাকতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সেখান থেকে আমাদের বিতাড়িত করা হয়। বাবার বাড়ি চলে আসলাম সন্তানদের নিয়ে। শুরু হলো পাড়া-প্রতিবেশীদের নানা আলোচনা-সমালোচনা। শুনতে-শুনতে মনে মনে একটি প্রশ্ন দাগ কেটে গেল ‘স্বামী মারা গেলে মেয়েদের এতো নির্ভরশীল থাকতে হবে কেন?’ ভাবলাম কাজ শুরু করবো। কিন্তু মানসম্মত কাজ পেতে তো পড়াশোনা জরুরি, আমি তো আন্ডার মেট্রিক। আবারও শুরু করলাম পড়াশোনা। সফলতার সাথে মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক এবং গ্র্যাজুয়েশন শেষ করলাম।

‘পড়াশোনার সময় আমি হাতের কাজের পোশাক তৈরি শুরু করেছিলাম। করতে-করতে বেশ পারদর্শী হয়ে উঠি এবং একজনের মাধ্যমে চিটাগং ও সিলেটে বেশ ভালো মার্কেট তৈরি হয় আমার। এটি ২০০০ সালের কথা। সকলের এত সাড়া দেখে আমি নাটোরের জনপ্রিয় উত্তরা সুপার মার্কেটে একটা শো-রুম নিলাম। সন্তানদের নিয়ে এভাবে বেশ ভালোই চলছিল। কয়েকজনের কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হয়েছিল। তবে কিছুদিন পর সেখানে বিরাট বাধার সম্মুখীন হই। আমাকে জানানো হয় মার্কেটে কোন মহিলার শোরুম থাকবে না। সেখান থেকেও বিতাড়িত হলাম।‘

তিনি বলেন: পরবর্তীতে সৌভাগ্যক্রমে আমার পরিচয় হলো টাইকোডার্মার উদ্ভাবক ডা. ইলিয়াসের সাথে। সেখান একটি ল্যাবে কাজ শুরু করি। আমারও শেখা হয়, পাশাপাশি প্রশিক্ষণ দিতেও শুরু করি। এভাবে পড়াশোনা করতে করতেই আমি এই সেক্টরে আসি। সবুজায়ন নামে একটি নার্সারিও গড়ি আমি। সেখান ফল-ফুলের চারা রয়েছে। বর্তমানে হাছিনা এগ্রোর গুরুত্বপূর্ণ অংশ সবুজয়ান নার্সারি।

২০০৫ সাল একটি হাইস্কুলে তার চাকরি হয়। সেখানেও বেশ ভালো চলছিল। বছরের পর বছর অতিবাহিত হওয়ার পর এমপিওভুক্ত হয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন তিনি। ভেবেছিলেন এইবার হয়তো শত কষ্টের অবসান হলো, বাচ্চাদের নিয়ে এবার ভালোভাবে বাঁচতে পারবেন। কিন্তু কিছুদিন না যেতেই ২০১৪ সালের দিকে তাকে স্কুল থেকে বাতিল করা হলো। ‘২০০৫ থেকে ২০১৪ জীবনের বড় সময় অতিবাহিত করেছি যেখানে সেখান থেকেও বঞ্চনা নিয়েই আমাকে বের হতে হয়েছে। নাটোরের চ্যাপ্টার সেখানেই ক্লোজ করে চলে আসি রাজশাহীতে।’

এরপর বৃহৎ পরিসরে কাজ শুরু করেন হাছিনা এগ্রো এন্টারপ্রাইজ নিয়ে। ভোর থেকে রাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন সহযোদ্ধাদের নিয়ে। বর্তমানে হাছিনা এগ্রো এন্টারপ্রাইজের আওতায় আরও প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সবুজায়ন নার্সারি, কৃষি বিপণী এবং এসেন্সিয়াল সিডস। প্রতিটি নামই বেশ পরিচিতি পাচ্ছে সকলের মাঝে। শুরুতে জমি লিজ নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন। এখনও ৬ বিঘা জমি লিজ নিয়েছেন, কয়েক কাঠা কিনতে সক্ষম হয়েছেন। আগে হাতে সব কাজ হলেও মেশিন যুক্ত করেছেন, তাদের দুটি পিকআপ রয়েছে। খুব শীঘ্রই নতুন কিছু মেশিন যুক্ত করতে যাচ্ছেন। আশা রাখছেন, এতে কারখানার উৎপাদন বহুগুণ বাড়বে।

‘আজ সারা বাংলাদেশে আমার পণ্য যাচ্ছে। দেশের স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান আমার কাছ থেকে পণ্য নিচ্ছে। কারখানায় ৩৫ জন এবং মাঠ পর্যায়ে অসংখ্য লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পেরেছি। আমার এ কাজে বর্তমানে মেয়ে, জামাই সকলেই সমানতালে সহযোগিতা করে যাচ্ছে। আমাকে আরো সাহস যোগাচ্ছে আগামী দিনের জন্য,’ বললেন হাছিনা ইয়াসমিন।

কাজের অভিজ্ঞতাকে আরো সমৃদ্ধ করতে বগুড়া আরডিএ, কৃষি অধিদপ্তর, বিআরডিসি, বিসিক এবং হর্টিকালচার থেকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন এই উদ্যোক্তা।

কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ২০০৯ সালে নাটোর অবস্থানকালে সবুজায়ন নার্সারির জন্য জেলার শ্রেষ্ঠ জয়িতা সম্মাননা পান হাছিনা ইয়াসমিন। এছাড়াও রাজশাহীতে বৃহৎ পরিসরে উদ্যোগ শুরুর পর উপজেলা, জেলা এবং বিভাগীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ জয়িতা হয়েছেন এই উদ্যোক্তা। আরও অসংখ্য সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন হাছিনা।

স্থানীয়রা বলছেন, হাছিনা ইয়াসমিন এখন রোল মডেল। একজন নারীর চলার পথে প্রতিটি ধাপে-ধাপে যে বাধা আসে, পুরুষশাসিত সমাজ যেভাবে নারীদের দমিয়ে দিতে চায়; সেখানে সব বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে তিনি অনুকরণীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন।

তামান্না ইমাম,
উদ্যোক্তা বার্তা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here