ইংলিশ চ্যানেল পেরিয়ে ‘বাংলা সেলাই’

0
উদ্যোক্তা মোঃ আমিনুল ইসলাম

সেলাই কি কখনো খেলা হতে পারে? রুমাল, শার্ট, পান্জাবি কিংবা কাঁথায় সেলাই করা ছিল একমাত্র খেলা। মা, প্রতিবেশী এবং আত্মীয়স্বজনদের কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের সেলাই শেখাটা যেন নেশার মতো ছিল। ছোটবেলা থেকে খেলাধুলার চেয়ে সুঁই-সুতোর কাজেই বেশি আনন্দ পেতেন মোঃ আমিনুল ইসলাম। সেই আনন্দ আর ভালোবাসা থেকেই উদ্যোক্তা হয়ে উঠা। দীর্ঘ ৩২ বছর ধরে ‘বাংলা সেলাই’ নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন উদ্যোক্তা আমিনুল৷ 

ঝিনাইদহ জেলার শৈলকূপা থানার লক্ষণদিয়া গ্রামের গোলাম কাওসার আলীর ছোট ছেলে আমিনুলের লেখাপড়ার পাশাপাশি সেলাই এর প্রতি ছিল প্রবল আকর্ষণ। ১৯৯০ সালে ধানমন্ডি আড়ং এর পাশ দিয়ে ডিগ্রি পরীক্ষা দিতে যাওয়ার সময় সাজানো ম্যানিকুইনগুলো দেখে ভাবতেন ‘আহ! আমার তৈরি পোশাক যদি এই ডলের গায়ে পরানো থাকতো!’

একদিন নিজের করা ডিজাইন ও হাতের কাজ করা শার্ট, পান্জাবি, ফতুয়া নিয়ে আড়ং এর চিফ ডিজাইনারের সাথে দেখা করেন। আমিনুলের নিখুঁত হাতের কাজ দেখে রীতিমত অবাক সেই ডিজাইনার। ১৫ দিন পর আবার দেখা করতে বললেন তিনি।

১৫ দিন পর ডিজাইনারের কথামতো দেখা করেন আমিনুল। তারই একটি শার্টের ডিজাইন থেকে ১০০ পিস ইয়োক, ৭০ টাকা করে মোট ৭ হাজার টাকার প্রথম অর্ডারটি পেয়ে যান তিনি।

জীবনের প্রথম অর্ডারটি পেয়ে একদিকে যেমন আনন্দিত, অন্যদিকে বেশ চিন্তায় পড়ে গেলেন। একা একা কীভাবে এতোগুলো কাজ শেষ করে জমা দিবেন? 

অনেক ভেবে কাজগুলো গ্রামের বাড়ি নিয়ে যান। আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশীকে কাজ শিখিয়ে অনেক কষ্টে সময়মতো কাজটি শেষ করে জমা দেন। সেই থেকে উদ্যোক্তা হবার এক অদম্য বাসনা পেয়ে বসে তাকে। আড়ং সারা বছর বিভিন্ন সময়ে নানা সামগ্রীর অর্ডার দিয়ে থাকে। আমিনুল বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় গ্রামে গ্রামে গিয়ে কর্মী তৈরি করেন এবং তাদেরকে দিয়ে কাজ করিয়ে আনেন।

বত্রিশ বছর আগে মাত্র ২০ জন কর্মী নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন। এখন প্রায় ১,২০০ কর্মী তার সাথে কাজ করছেন। সকল প্রকার ডিজাইন এবং হাতের কাজ হয়ে থাকে নিজ জেলা ঝিনাদহ ছাড়াও বেশ কয়েকটি জেলায়। আর ঢাকার উত্তরায় রয়েছে তার কারখানা। সেখানে কর্মী রয়েছে আরও ৪০ জন।

বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী সেলাই শিল্প নিয়ে কাজ করেন বলে উদ্যোক্তা আমিনুল ইসলাম তিনি তার উদ্যোগের নাম দিয়েছেন ‘বাংলা সেলাই’। অনলাইন এবং অফলাইন দুই প্লাটফর্মেই কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। হাতের কাজ করা ইয়োক, এস কে ডি, পান্জাবি, শাড়ি, ফতুয়া, ট্যাপেস্ট্রি, জয়েলারি বক্স এবং হাউজহোল্ড সামগ্রীর মধ্যে রয়েছে বেডশিট, পর্দা, কুশন-কাভার ইত্যাদি।

সরাসরি না হলেও বিভিন্ন কোম্পানির মাধ্যমে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও ইংল্যান্ডে তার কুশন-কাভার, টপস্, ওয়েডিং গাউন রপ্তানি করেছেন। মাসে প্রায় ৩ হাজার পিস বিভিন্ন আইটেমের পণ্য উৎপাদন করে থাকেন তার কারখানায় এবং ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকার পণ্য বিক্রি করে থাকেন।

‘বাংলা সেলাই’ এর স্বত্ত্বাধিকারী মোঃ আমিনুল ইসলাম বলেন, “আমি আমার কাজ করে একটা উদাহরণ সৃষ্টি করেছি। তবে এটা এতোটা সহজ ছিল না। আমি ছোট বেলায় যখন এই কাজগুলো করতাম প্রত্যেকটা মানুষ আমাকে বিভিন্নভাবে কটূকথা বলতো। আজ আমার কারখানায় ৪০জন কর্মী কাজ করে তারা তাদের সংসার চালায়। এছাড়াও ১,২০০ আর্টিজান যারা তাদের সংসারের কাজ শেষে আমার এই সেলাইয়ের কাজ করেন তারা তাদের সংসারে বেশ কিছুটা সহযোগিতা করতে পারেন। যখন তারা এসে বলেন, এই কাজ করে টিভি কিনেছি কিংবা ফ্রিজ কিনেছি বা স্বামীর লোন শোধ করেছি বা বাচ্চাদের লেখা পড়ায় খরচ করেছি অথবা মেয়ের বিয়ের গহনা কিনেছি– তখন মনে হয় আজ আমি সার্থক। যারা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কটূ কথা বলতেন, তিরস্কার করতেন; আজ তারাই আমার কাজের জন্য বাহবা দেন।”

আমিনুল জানান, তার কাজ নিয়ে তিনি ভারত, হংকং, থাইল্যান্ড, কোরিয়া, জাপান, ইটালি এবং ফ্রান্সে প্রদর্শনী করেছেন। “আমার কাজ নিয়ে দেশের অনেক নামকরা পত্রিকায় ছাপা হয়, এমনকি বিদেশের অনেক পত্রিকাতেও ছাপা হয়েছে। এখন মনে হয় বেঁচে থেকে মানুষের জন্য একটু হলেও কিছু করতে পেরেছি এবং নিজের একটা অবস্থান তৈরি করতে পেরেছি।”

তিনি বলেন: কোন কাজই আসলে ছোট না। যে যে কাজই করুক না কেন সেই কাজের প্রতি থাকতে হবে নিষ্ঠা এবং ভালবাসা। তবেই সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারবে।

সেতু ইসরাত
উদ্যোক্তা বার্তা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here