মাত্র দশ হাজার টাকা নিয়ে বি.এস.সি তে পড়ুয়া একজন ছাত্রী যাত্রা শুরু করলেন একজন উদ্যোক্তা হয়ে, ২০০৫ সালে। তিনি চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যকে বেছে নিলেন ব্যবসার পথ হিসেবে। একজন কর্মী এবং একটি সেলাই মেশিন নিয়ে তার যাত্রা শুরু হলেও আজ ২০১৬ সালে প্রায় ৪০ জন কর্মী ও ২০০ জন অনিয়মিত কর্মী নিয়ে সফলতার সাথে ব্যবসা পরিচালনা করছেন সেই তরুণ ছাত্রীটি, আজ একজন তরুণ উদ্যোক্তা হয়ে।

বিশ্ববিদ্যালয় এ পড়াশোনা করবার সময়ই ব্যবসা শুরু করেন। ২০০৫ সালে, বি.এস.সি ফাইনাল ইয়ার এর একজন ছাত্রী তানিয়া ওয়াহাব। ১০ হাজার টাকা মূলধন। যেহেতু চামড়া শিল্পের একজন ছাত্রী, এখানে নিজের ভবিষ্যৎ গড়ার প্রয়োজন অনুভব করলেন। তাই জানার জন্য, নিজের জ্ঞানকে বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন ট্যানারি বংশালে ঘুরে ঘুরে ব্যবসার ভুবনটি চেনা, দেখা সোর্সিংটার সম্পর্কে সম্পূর্ণ  জ্ঞান আহরণ করলেন। একটি মেশিন এবং একজন কর্মী, নিজেই ডিজাইনার। পুরো কাজ একটি মেশিন দিয়ে সম্পূর্ণ করাটা ছিলো কষ্টসাধ্যের ব্যাপার কিন্তু সেটি সম্ভব করলেন তানিয়া ওয়াহাব। অন্য ফ্যাক্টরি এবং বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অফ লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড টেকনোলোজির সাহায্য নিয়ে ‘এথিলি’ নামের ছোট্ট একটা ১০০ স্কয়ার ফিট এর শো রুম নিয়ে এবং  একটি মেশিন নিয়ে তার পথ চলা শুরু করলেন।

উদ্যোক্তার সফলতার গল্প দেখুন ইউটিউবে-দেখতে ক্লিক করুন

কর্পোরেট গিফট আইটেমের চাহিদা অনেক এবং পণ ছিলো, নিজের পরিচিত কোথাও ব্যবসা নয় প্রথমেই।
ভীষণ পরিশ্রম নিজের কারখানা এবং শো রুমে। সকল কাজ সম্পূর্ণ করতে ১৬-১৭ ঘন্টা কাজ শুরু করলেন তানিয়া ওয়াহাব। প্রত্যয় এবং পণ যদি থাকে দৃঢ় তাহলে সফলতা আসতে শুরু করে। ধীরে হলেও একটি ব্যাংকের ডায়েরির অর্ডার মিললো। দারুণ এক প্রোডাকশন সম্পূর্ণ করলেন  উদ্যোক্তা তানিয়া ওয়াহাব। ১০ জনকে নিয়ে একটি টিম করে ফেললেন, আত্মবিশ্বাস বাড়লো অনেক গুণ।

পণ্য তৈরির কাজে কর্মীগণের ব্যস্ততা

তানিয়া ওয়াহাব উদ্যোক্তা বার্তাকে বলেন, ‘২০০৮ সালে, প্রথম সফলতার সিঁড়ির দেখা পেলাম। নিজের গবেষণালব্ধ জ্ঞানের মাধ্যমে মাত্র ৩ বছরে কর্ম সাফল্যের পথ দেখতে পাওয়ার সৌভাগ্য হলো’।

ইতালির একজন বিশেষজ্ঞ বারবারা গার্ড ডৌউজি, বিখ্যাত ডিজাইনার। ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড ফেয়ার ‘জেনিভ’ এর জন্য ১০ জন বড় ব্যবসায়ীদের সাথে ১১ তম সদস্য হলেন তানিয়া ওয়াহাব। ইতালির মিলানে রিপেল ফেয়ারে সেখানে অংশ নিলেন তানিয়া ওয়াহাব। মিললো আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিতি এবং দেখা হলো আন্তর্জাতিক এক ভুবন। একই বছর বাংলাদেশে এসএমই ফাউন্ডেশনের শ্রেষ্ঠ নারী উদ্যোক্তার পুরষ্কার এনে দিলো অনুপ্রেরণার এক মহাআশ্রয়। সম্ভব, অবশ্যই সম্ভব।

অর্ডার আসতে শুরু করলো বড় বড় ব্যাংক, বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান, আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান এবং নানা কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে কাজ আসতে শুরু করলো এবং কাজ অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে সম্পূর্ণ করে, গুণগত মান ঠিক রেখে, সময় নিয়ন্ত্রণে অর্ডার পূর্ণ করলেন তানিয়া ওয়াহাব।

কারিগর নামে একটি প্রতিষ্ঠান খুললেন আইলেটের একজন ছাত্রের সাথে। তানিয়া ওয়াহাব উত্তরবঙ্গ থেকে ৫ জনকে এনে ট্রেনিং দিয়ে দক্ষ কর্মী বাহিনী হিসেবে গড়ে তুললেন। শো রুম সাজালেন, মেশিন বেড়ে দাঁড়ালো ৪টি। প্রতিনিয়ত নিজেকে গড়ায় বিশ্বাস করেন তানিয়া ওয়াহাব। সব সময় নিত্য নতুন ব্যবসায়কে, উদ্ভাবনী শক্তিকে কাজে লাগিয়েছেন উদ্যোক্তা। বারবারা জীবনের শিক্ষাগুরু, তার একটি কথাই তানিয়া হৃদয়ের অন্তঃস্থলে ধারণ করেছিলেন ‘তোমার নিজেস্ব অঞ্চল এবং তোমার শক্তিটিকেই কাজে লাগাও’। আর এই মূল মন্ত্রটি এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকলো তানিয়া ওয়াহাব কে। শুধু মাত্র চামড়া নয়, প্রথমে পাট, পাটকে চামড়ার সাথে মিশিয়ে পন্য ডিজাইন করলেন।

কর্মব্যস্ত উদ্যোক্তা তানিয়া ওয়াহাব

লন্ডন থেকে অর্ডার মিললো, গ্রেট ব্রিটেনে ৩০০ পিস ব্যাগ পাঠালেন তানিয়া। আন্তর্জাতিক মহল থেকে অনেক প্রশংসা কুড়ালেন। এরপর নকশী কাঁথা, সিল্ক, গামছা, আদিবাসীদের কাপড় নিত্যনতুন নানান ডিজাইনে চামড়ার সাথে। ডায়েরি, কনফারেন্স ব্যাগ, ফটো ফ্রেম, লেদার ব্যাগ এবং নিজেস্ব প্রোডাক্ট লাইনে প্রায় ১৭টি প্রোডাক্ট। ইন্টারন্যাশনাল ভিজিটারস লিডারশীপ প্রোগ্রাম, ইউনাইটেড স্টেট ডিপার্টমেন্টের গেস্ট হয়ে গেলেন আমেরিকা, ১৯টি দেশ থেকে অতিথি আসলেন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে চামড়াজাত শিল্পের জ্ঞান আরো সমৃদ্ধ হলো তানিয়া ওয়াহাবের।

তানিয়া ওয়াহাব উদ্যোক্তা বার্তাকে বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই আমি খুব চঞ্চল, যার কারণে আমি চাকরি করবো বলে কখনো ভাবি নি। কোথাও যদি মেলা হতো, দেশীয় পণ্যের স্টলের প্রতি আমার আলাদা আগ্রহ কাজ করতো এবং সেখান থেকেই আমার একজন সফল উদ্যোক্তা হবার স্বপ্ন জন্মেছিলো। আমি সব সময় চেয়েছি যে নিজে সৃজনশীলতার কাজে কর্মরত হবো, নিজে কর্মব্যস্ত হবো এবং অন্যদের কর্মসংস্থান করবার চেষ্টা করবো’।

২০১১ সাল, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধান মন্ত্রী রাষ্ট্রীয় সফরে আমন্ত্রণ পান, সেই বছরই সর্ব কনিষ্ঠ সদস্য হিসেবে। এফ ডি সি সি আই এবং বিজনেজ চেম্বারস এর শীর্ষ সকল নেত্রীবৃন্দের সাথে পরিচিত হলেন উদ্যোক্তা। ইতালি, জার্মানি তে বৃত্তি, ইকো ফ্রেন্ডলি লেদারস এর উপরে। সম্পূর্ণ করলেন এক উচ্চতর কোর্স। আমেরিকা, মালয়েশিয়া তে গেলেন ডিজাইনের কোর্সের ওপর এবং মুম্বাইতে গেলেন আই এস ও ট্রেনিং এর জন্য। যোগ দিলেন বাংলাদেশ ওয়েমেন চেম্বার অফ কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সর্ব কনিষ্ঠ বোর্ড পরিচালক হিসেবে। কর্ম পথে নিজের পরিচয় বেড়ে যায় আরো অনেক অনেক গুণ। এসএমই ফাউন্ডেশনে গভার্নিং বডি মেম্বার হলেন উদ্যোক্তা।

২০১৫ সাল, আড়ং, কে ক্রাফট, ওয়েস্টেক্স আজ উদ্যোক্তার ক্লাইন্ট। ৫৫ হাজার পিস লেদার বক্সের একটি অর্ডার উদ্যোক্তার জীবনের গতিপথকে ঘুরিয়ে দিলো বহু গুণে। উদ্যোক্তা এই অর্ডারটি সম্পূর্ণ করলেন সফলতার সাথে, এবং এই একটি টার্নিং পয়েন্ট উদ্যোক্তাতে নিয়ে যায় শিল্প-স্বপ্নের সফলতার সততার স্তরে।

উদ্যোক্তার ফ্যাক্টরিতে পণ্য তৈরির কাজ চলছে

‘ট্যান’ নামে নিজের একটি ব্র্যান্ড কে ইন্ট্রোডিউস করলেন উদ্যোক্তা। ১১ বছরে উদ্যোক্তা এবার প্রতিষ্ঠা করলেন, তার নিজের লেদার প্রোসেসিং ব্র্যান্ড, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শব্দ যা সকলের কাছে চেনা ‘ট্যান’, সেই ট্যান টি হলো তার ব্র্যান্ডের নাম। চাবির রিং থেকে লেদার জ্যাকেট পর্যন্ত ডিজাইনের এক নিজস্ব ভুবনে তার প্রোডাক্ট লাইন সাজালেন তানিয়া ওয়াহাব, তার শো রুমে। আন্তর্জাতিক যে ফ্যাশন শো গুলো বাংলাদেশে হয় সেগুলোর চামড়াজাত পণ্য তাও আজ সম্পূর্ণ রূপে সরবরাহ করতে সক্ষম আন্তর্জাতিক মানে উদ্যোক্তা তানিয়া ওয়াহাব।

তবে তানিয়া ওয়াহাব তরুণ উদ্যোক্তাদের উদ্দেশ্যে পরামর্শ দিয়ে বলেন, ‘একজন উদ্যোক্তার ধৈর্য থাকতে হবে, সততা থাকতে হবে এবং নিজের কাছে পরিষ্কার থাকতে হবে যে আমি যা করছি তা সঠিক আছি কি না, সময়জ্ঞান ঠিক রেখে এবং সততার জায়গাটায় অনড় থেকে প্রত্যেক কাজ সম্পূর্ণ করবার চেষ্টা এবং লক্ষ্যই একজন উদ্যোক্তা কে সফলতার পথে এক পা দু’পা করে এগিয়ে নিয়ে যাবে’।

২০০ স্কয়ার ফিট এর শো রুম নিয়ে যাত্রা শুরু করা, ১০০ জন কর্মীদের নিয়ে দাঁড়িয়েছে চার হাজার স্কয়ার ফিটে। পুরস্কার মিলেছে প্রচুর, ২০১৩ সালে ডেইলি স্টার, বাংলাদেশ বিজনেস অ্যাওয়ার্ড, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ অ্যাওয়ার্ড, কাজী নজরুল স্বর্ণ পদক উদ্যোক্তাকে দেখিয়েছে সামনে এগিয়ে যাবার আলো। আজ ৪০ জন কর্মী এবং ২০০ জন অনিয়মিত কর্মী নিয়ে ১ কোটি টাকা মূল্যমানের ব্যবসায় পরিচালনা করছেন সফল উদ্যোক্তা তানিয়া ওয়াহব।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here