উদ্যোক্তা-শারমীন মোস্তাফি কনি

পুরোদস্তুর সংসারী একজন মানুষ আমি পাশাপাশি একজন নারী উদ্যোক্তা। পড়ালেখা করেছি  পটুয়াখালীর একটি কলেজ থেকে। এরপর মাস্টার্স করেছি বরিশালের ব্রজমোহন করেজের দর্শন বিভাগ থেকে।

লেখাপড়া শেষ করে একসময় চাকরিও করতাম কিন্তু পরিবারকে সময় দেওয়ার জন্য চাকরিটা ছেড়ে দেই। চাকরিটা করার ইচ্ছে ছিলো কিন্তু করতে পারিনি। আমার স্বামী হাবিবুর রহমান খান মেরিন ইঞ্জিনিয়ার। তিনি বেশীরভাগ সময় দেশের বাইরে থাকতেন। আমিও তার সঙ্গে দেশের বাইরে বেশ কয়েকবছর সময় কাটিয়েছি। এছাড়া পরিবারকে সময় দেওয়ার ব্যাপার। সবমিলিয়ে চাকরিটা আর করতে পারিনি।

ব্যবসা শুরু করবো এরকম ইচ্ছে ছিলোনা, কিন্তু ছোটবেলা থেকে ক্রিয়েটিভ কিছু করার ইচ্ছে ছিলো অনেক। ঝোঁক ছিল নিজস্ব কিছু করার।

অস্ট্রেলিয়ায় থাকা আমার এক বন্ধু শাওন আমার ব্যবহৃত পোশাক দেখে আগ্রহ দেখায় আমি যেনো তাকে ওই ধরনের বেশ কিছু পোশাক বানিয়ে দিই। ওই সময় আমাকে ৩০-৪০ হাজার টাকা দিয়েছিলো সে। সেই টাকা দিয়ে বিভিন্ন ডিজাইনের  পোশাক বানাই এবং তাদের পার্সেল করে পাঠিয়ে দিই। তারা পোশাক দেখে এতো খুশি হয় যে, সবগুলো ড্রেসই সবাই খুব পছন্দ করে এবং আরো অর্ডার দেয়। সেই থেকেই আগ্রহ শুরু।

উদ্যোক্তার নতুন কারখানা

একটা ভাল টেইলর ছিলো যেকোন ডিজাইন বললেই করতে পারতো এবং আশপাশের সবাইকে ড্রেস বানিয়ে দিতাম সবাই আবার অর্ডারও দিতো। এভাবেই কালেকশন বাড়াই, বিভিন্ন মেলা করি। কিন্তু বাইরের মাস্টার কারিগরদের যে মজুরী সেটা অনেক বেশী তাই অনেকদিন থেকেই নিজস্ব ফ্যাক্টরি করার ইচ্ছে ছিলো। ইনশাআল্লাহ এখন সেই সপ্ন পূরণ হয়েছে। আর ড্রেস এবং শাড়ি এখন সময়মতো সবার হাতে তুলে দিতে পারবো ভেবেই খুবই ভাল লাগছে।

আমি মসলিন নিয়ে বেশী কাজ করি। এসএমই মেলাতে আমার মসলিম ড্রেস সবাই খুব পছন্দ করে। অর্ডার দেয়। এছাড়া আমার আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব সবাই আমাকে উৎসাহ দিয়ে আসছে শুরু থেকেই, যার জন্য সবার কাছে আমি অনেক কৃতজ্ঞ।

কাজ করছি ৭/৮ বছর ধরে। আগে অনেক মেলা করতাম যখন শপ ছিলোনা। উত্তরার আলাউদ্দিন টাওয়ারে শোরুম নিয়েছি বছর দুয়েক হল। আর কিছুদিন আগে ফ্যাক্টরি নিয়েছি। দেশের বাইরেও যাচ্ছে আমার পোশাক। অস্ট্রেলিয়া, লন্ডনেও আমার ক্রেতা রয়েছে।

এটা এখন শুধু ব্যবসা নয়, এখানে কর্মসংস্থান হয়েছে বেশকিছু মানুষের। ফ্যাক্টরিতে কাজ করছেন ৮/১০ জন কর্মী। যারা ক্রেতাদের চাহিদামতো পোশাক সরবরাহ করতে সহায়তা করেন। এছাড়া অনিয়মিত আরো বেশকিছু কর্মী আছে যখন কাজের চাপ বেশী থাকে তখন তাদের কাজ দেয়া হয়। তবে এক্ষেত্রে দক্ষ কর্মীর অভাব রয়েছে, কর্মদক্ষ লোক পাওয়া খুব দুষ্কর। দক্ষ যারা আছেন তাদের পারিশ্রমিক বেশি। আর পারিশ্রমিক বেশি হওয়ায় প্রোডাকশন খরচও বেশি পড়ে কিন্তু কাস্টমার সেটা বুঝতে চায়না, তারা ইন্ডিয়ান এবং পাকিস্তানি ড্রেসের উদাহরণ যখন দেয় তখন খারাপ লাগে।

AWE এর একটি প্রোগ্রামে নারী উদ্যোক্তা সংগঠনের উদ্যোক্তাগণ

ব্যবসা করার বেলায় প্রশিক্ষণও দরকার পড়ে। কারণ নিজে আগে দক্ষতা অর্জন করা জরুরি। বিজিএমই থেকে ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ে কোর্স করেছি। এসএমই ফাউন্ডেশন থেকে বিজনেস ম্যানেজমেন্টে কোর্স করেছি। এমব্রয়ডারি কোর্সও করেছি, এফ কমার্স কোর্সসহ অনেক ধরনের ট্রেনিং নিয়েছি।

আমার শপ এ ক্যাজুয়াল পোশাকের পাশাপাশি রয়েছে মসলিনের বিশাল কালেকশন।  সময়গুলো শুধু ব্যবসার জন্য নয়, পরিবারের জন্যও বরাদ্দ রাখতে হয়। আমি একজন উদ্যোক্তার পাশাপাশি আমার আরেকটি পরিচয় আমি একজন মা। সুতরাং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মতো সংসারটাকেও আগলে রাখি, ছেলে-মেয়েদের সময় দিতে হয়।

তবে এগিয়ে চলার পথ এতটা সহজ ছিলোনা। কিন্তু আমি লেগে ছিলাম, হতাশ হইনি কখনো।  ৩০ হাজার টাকার বিনিময়ে সরকারিভাবে আমি দুটো প্লট পাই। ব্যবসার প্রয়োজনে আমি একটা প্লট বিক্রি করি ৪ লাখ টাকায়। ওই টাকা দিয়েই ব্যবসাটি শুরু করি।

বর্তমানে উত্তরার পাশাপাশি  আরেকটি শোরুম নেওয়ার চিন্তা করছি। নিজের অবস্থান থেকে নিজে ভালো আছি। শুধু একজন উদ্যোক্তা হিসেবে নয়, বেতারের একজন উপস্থাপক হিসেবেও কাজ করছি। ২০০৬ সাল থেকে আমি বাংলাদেশ বেতারের তালিকাভুক্ত শিল্পী।
জনপ্রিয় ম্যাগাজিন উত্তরণসহ অনেক অনুষ্ঠান করেছি এছাড়া সংবাদ পাঠও করি।

মেলায় অংশ গ্রহনকালীন উদ্যোক্তার স্টল

নিজের ব্যবসার পাশাপাশি এই কাজটি যোগায় মনের খোরাক। বাংলাদেশ বেতারের ৭৫ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন অনুষ্ঠানে সকল অ্যানাউন্সারদের জন্য ১০০ টির মতো শাড়ির ডিজাইন করেছিলাম আমি।  এই কাজটি ছিলো খুবই আনন্দের। এখানেও বেশ প্রশংসা পেয়েছি।

একজন নারী উদ্যোক্তা হিসেবে উদ্যোক্তাদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব উইমেন এন্টারপ্রাইনার  Awe এর সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। এই সংগঠনের মাধ্যমে নারী উদ্যোক্তাদের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করছি। আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করি সবাইকে সহযোগিতা করতে।

নারীদের প্রতিষ্ঠিত হতে হলে নানানরকম সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে যেতে হয় এবং হবে। কিন্তু সেটা অতিক্রম তাকে নিজেকেই করতে হবে, কখনোই হতাশ হওয়া যাবেনা। আমি চাই আমার এখানে কর্মসংস্থান হোক আরো অনেকের, এছাড়াও আমি চাই দেশের সীমানা ছাড়িয়ে আমার এই উদ্যোগ পা রাখুক আন্তর্জাতিক অঙ্গনের বিভিন্ন সীমানায়।

শারমীন মোস্তাফি কনি
নারী উদ্যোক্তা ও উপস্থাপক

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here