উদ্যোক্তা- আয়েশা সিদ্দিকা

অনলাইনে ছোট পরিসরে ব্যবসা (হস্তশিল্প, বুটিকস, শাড়ি, কসমেটিকস) করে অনেক ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা নিজেদের জাত চিনিয়েছেন। তবে একজন নারী উদ্যোক্তা হয়ে অনলাইনে মাছ বিক্রির চ্যালেঞ্জ বোধহয় শুধুমাত্র আয়েশা সিদ্দিকা নিজেই নিয়েছেন। মাত্র ৩৫ দিনে এক লাখ টাকার বেশি মাছ বিক্রি করেছেন। ইচ্ছা আসে মোবাইল অ্যাপসের মাধ্যমে সারা দেশের ভোক্তাদের ফর্মালিনমুক্ত মাছ বিক্রি করা।

জ্বি পাঠক বন্ধুরা, বলছিলাম খুলনার মেয়ে আয়েশা সিদ্দিকার কথা। যার উচ্চতর শিক্ষা নিতে রাজধানীতে আসা ২০০৯ সালে। শুরুতে ব্যাংকসহ বেশকয়েকটি বেসরকারী চাকরি করলেও গত চারবছর ধরে নিজেকে গার্মেন্টস অ্যাক্সেসরিজ উদ্যোক্তা পরিণত করার পর চলতি বছরের জানুয়ারিতে শুরু করলেন অনলাইন প্লাটফর্মে মাছ বিক্রি। নাম দিলেন ফিশঢাকাডটকম।

সম্প্রতি আয়েশা সিদ্দিকার সঙ্গে কথা হয় উদ্যোক্তা বার্তার। একান্ত আলাপচারিতায় উঠে আসে ফিশঢাকা নিয়ে নানা কথা।

ব্যাংকার থেকে উদ্যোক্তা কিভাবে হলেন জানতে চাইলে আয়েশা বললেন, ২০০৯ সালে এমবিএ করতে ঢাকায় আসলেও এক মাসের মাথায় সিটি ব্যাংক এনএতে ট্রেড সার্ভিস ডিপার্টমেন্টের এক্সিকিউটিভ হিসেবে আমার চাকরি হয়। পরে সাউথ ইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস সাতেক পর এক্সিকিউটিভ এমবিএতে ভর্তি হই। এরমধ্যেই এমবিএর শেষদিকে ব্যাংক আলফালাহ’তে কনজ্যুমার ডিপার্টমেন্টে যোগদান করি। সেখানে দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের পরও পদোন্নতি না পাওয়ায় ব্যাংক ছেড়ে দিয়ে জাপানিজ ইয়োকোহামা লেবেল এবং প্রিন্টিং (বিডি) কোম্পানিতে যোগ দেই। এরপর দুইটি চাইনিজ কোম্পানিতেও কাজ করেছি।

‘ট্র্যাক পরির্বতনের পরই মনে হলো আর চাকরি নয়, ব্যবসা করতে হবে। আর ব্যবসা করতে গেলে আমার আগে জানতে হবে। আমি চাকরির পাশাপাশি ব্যবসা সম্পর্কে বিভিন্নভাবে জ্ঞান আহরণ করলাম। তারপর ২০১৬ সালে আমি আমার অ্যাক্সেসরিজ ব্যবসা শুরু করি। যেহেতু আমার গার্মেন্টসে চাকরির অভিজ্ঞতা ছিল তাই নিজের অ্যাক্সেসরিজ ব্যবসা ভালোই চলছিল। এই ব্যবসা করতে গিয়ে আমি দেখেছি পণ্য সব আমরা বিদেশে রপ্তানী করি। তখন দেশের প্রতি টান থেকে মনে হলো দেশের পণ্য দেশের মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে।’

‘আমি চাচ্ছিলাম ছোট পরিসরে কিছু একটা করি। আমি লক্ষ্য করলাম ই-কমার্স সেক্টরে বাংলাদেশ অনেক ভালো এগিয়েছে। এ ছাড়াও আমাদের ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য এসএমই ফাউন্ডেশন অনেক কাজ করছে। আমি ওম্যান অ্যান্ড ই-কমার্স (উই) গ্রুপে জয়েন্ট করি এবং এখানে ই-কমার্স সম্পর্কে অনেককিছু জানতে পারি এবং ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি রাজিব আহমেদের স্যারের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখি। সেখান থেকে জানতে পারি ব্যবসা করে গেলে আমাকে জানতে হবে নিজের পরিচিতি কোনদিকটাতে এবং নিজের শক্তিটা কোথায়। আমার মনে হলো আমি যেহেতু খুলনার মেয়ে সেখানে মাছের চাষ হয়, সেখানে চিংড়ি গবেষণা ইনস্টিটিউট আসে, ছোটবেলার থেকেই মাছের সঙ্গেই আমার বেড়ে ওঠা।’

মাছটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছি জানিয়ে তিনি বলেন: আমরা দেখি মাছ যখন দেশের বাইরে এক্সপোর্ট হয়ে যাচ্ছে সেগুলো অনেক ভালো মাছ থাকে। ওই মাছুগলো ঢাকায় সীমিত কিছু জায়গায় পাই। আমি চেয়েছি ভালো মাছ দেশের মানুষ আগে খাবে, পরে তা এক্সপোর্ট হবে।

মাছে কোনো প্রকার কেমিক্যাল বা ফর্মালিন থাকে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন ‘ বাজারে মিঠা পানির গলদা চিংড়ির কানশার ভেতর জেল পুশ করে ওজন বাড়ায়, এটা শরীরের জন্য ক্ষতিকর, আমি চিন্তা করলাম আমি যদি ঘের থেকে সরাসরি চিংড়ি আনতে পারি কোনপ্রকার মধ্যস্বত্বভোগী ছাড়াই তাহলে সবাই ফর্মালিনমুক্ত ভালো ও সঠিক মাছটা সবাই পাবে।

কোন কোন প্রকারের মাছ পাওয়া যায় জানতে চাইলে তিনি বলেন, লোনা পানি ও মিঠা পানির প্রায় সব রকমের মাছ এখানে পাওয়া যায়। রুই, কাতলা, কালবাউশ, সিলভার কার্প, কোরাল, কই, ট্যাংড়া, ফ্যাইশা, পাঙ্গাশ, চিতল, শিং, মাগুর।

কত টাকা কেজিতে মাছ বিক্রি করা হয় ? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, চিংড়ি অনেক রকমের আছে, ছোট চিংড়ির মধ্যে চালি চিংড়ি, মটকা চিংড়ি, ছোট গুড়ি চিংড়ি, এগুলো ছয়’শ থেকে সাড়ে ছয়’শ টাকা কেজি। সর্বনিম্ন এক কেজি বিক্রি করা হলেও অনেকে বিভিন্ন মাছ হাফ কেজি করে এক কেজি বা তারচেয়ে বেশি নেয়।

ঢাকায় বেশি রুই মাছ বিক্রি বেশি হয়, নদীর কোরাল ছয়’শ টাকা থেকে শুরু, দুই কেজির পর থেকে সাত’শ চার কেজির বেশি হলে নয়’শ। নদীর রুই মাছ তিন থেকে সাড়ে তিন’শ টাকা কেজি বিক্রি করেছি।

বিক্রি কেমন হচ্ছে? আয়েশা বললেন, চলতি বছরের জানুয়ারিতে চালু করা ফিশঢাকাডটকম কোনো প্রকার প্রচারণা ছাড়াই মাসে লাখ টাকার মাছ বিক্রি করল। এরপর আমি ব্যবসা সম্প্রসারণের চিন্তা করি একটা ডোমেইন কিনি, ওয়েব সাইটের কাজ চলছে, ফেসবুক পেইজটাও কিছুদিন আগে শুরু করেছি। যে পরিমাণ অর্ডার আসতেছে সে পরিমাণ সাপোর্ট দিতে পারছি না।

সামনে আসছে বৈশাখ, বাঙ্গালির নববর্ষ ইলিশ ছাড়া চলে না, বৈশাখের ইলিশের জন্য এখন থেকেই প্রি-অর্ডার নিচ্ছেন উদ্যোক্তা আয়েশা সিদ্দিকা।

তিনি জানালেন, কিছুদিন পর সরকার থেকে প্রায় ২২ দিনের মতো ইলিশ ধরা বন্ধ করা হবে। আর বৈশাখের জন্য ইলিশের যে চাহিদা সেটা মেটাতে এখনও আমি খুলনায় যারা ইলিশের মাছের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে অগ্রিম বুকিং দেয়া আছে।

মাছ সম্পর্কে গ্রাহকের মন্তব্য কেমন জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাকে ম্যাসেজ ও ম্যাসেঞ্জারে অনেকে উৎসাহমূলক মন্তব্য করে। তারা আসলে এমন মাছ ঢাকায় পায় না। তারা খুবই খুশি। একজন আপু কিছুদিন আগে জানালেন তার বাচ্চা মাছ খেত না, আমার কাছ থেকে ট্যাংড়া মাছ নেয়ার পর ছেলে বলেছে এরকম মাছ হলে আমি তিনবেলা মাছ খাব। অনেকে খেয়েই বলে যে আসলেই টাটকা ও নদীর মাছ।

খুলনায় তিনজন আর ঢাকায় চারজন নিয়ে শুরু করেছেন অনলাইনে মাছের ব্যবসা। গ্রাহকের কাছে ক্যাশ অন ডেলিভারি দিয়ে থাকেন আয়েশা।

ফিশঢাকাকে নিয়ে ভবিষ্যত পরিকল্পনা জানতে চাইলে আয়েশা বলেন: আমার অনেক পরিকল্পনা আছে, অনেক প্ল্যান আছে। কিভাবে গোড়া থেকে মাছ এনে দ্রুত সময়ের মধ্যে ভোক্তার হাত পর্যন্ত পৌঁছে দিব। পরিকল্পনা হলো ৬৪টা জেলায় শুধুমাত্র জেলায় না উপজেলা লেভেলেও বাজারগুলোতে ছোট ছোট মোবাইল শপ করা। ট্রাকে করে লাইভ ফিশও দেয়ার চিন্তা আছে। ভবিষ্যতে মোবাইল অ্যাপস করার ইচ্ছা আছে। যার মাধ্যমে অর্ডার করলে সরাসরি মাছ ভোক্তার কাছে পৌঁছে যাবে।

ডেস্ক রিপোর্ট, উদ্যোক্তা বার্তা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here