হকার থেকে বিশ্বসেরা ধনী স্যাম ওয়ালটন

0
স্যাম ওয়ালটন

স্যামুয়েল মুর ওয়ালটন ছিলেন একজন আমেরিকান ব্যবসায়ী এবং উদ্যোক্তা যিনি খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান ওয়ালমার্ট এবং স্যাম’স ক্লাব প্রতিষ্ঠার জন্য সবচেয়ে বেশি পরিচিত। ওয়ালমার্ট স্টোরস ইনকর্পোরেটেড আয়ের দিক থেকে বিশ্বের বৃহত্তম কর্পোরেশন এবং বিশ্বের বৃহত্তম বেসরকারি নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান।এক সময় ওয়ালটন আমেরিকার সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি ছিলেন।


স্যাম ওয়ালটন ১৯১৮ সালে ওকলাহোমার কিংফিশারে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা ছিলেন একজন কৃষক টমাস গিবসন ওয়ালটন। মা ন্যান্সি লি পরিবারের আর্থিক সঙ্গতি বাড়ানোর জন্য ছোট একটি দুগ্ধব্যবসা চালাতেন। স্যাম ছিলেন তার বাবা মায়ের প্রথম সন্তান। তার শৈশবেই তিনি যুক্তরাষ্ট্রের মহামন্দার সাক্ষী হয়েছিলেন। সেসময় পরিবারের আর্থিক চাহিদা পূরণের জন্য তাকে অনেক ধরণের কাজ করতে হয়েছে।
স্কুলে থাকা অবস্থায়ই স্যাম তার পরিবারকে সহায়তার জন্য খরগোশ ও কবুতর বিক্রির পাশাপাশি নিউজপেপার এবং ম্যাগাজিন ডেলিভারির কাজ করতেন। একবার নিউজপেপার কোম্পানি থেকে বলা হলো, যে বিক্রেতা একদিনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ম্যাগাজিন গ্রাহক করাতে পারবে তাকে ১০ ডলার দেয়া হবে। এখানে বলে রাখা ভালো, ১৯২০-৩০ এর দিকের ১০ ডলার মানে আজকের পৌণে দুইশ ডলার। স্যাম সেই ১০ ডলার না জিতে ঘরে ফেরেননি। চরম মন্দা চলাকালীন জীবন সংগ্রামের প্রেক্ষাপটে অর্থের প্রতি স্যামের যে সম্মান গড়ে ওঠে, পরবর্তী জীবনে অনেক বড় হয়েও তিনি তা প্রচণ্ডভাবে অনুভব করতেন।


তার পরিশ্রমী স্বভাব এবং কর্মচাঞ্চল্যের কারণে তিনি কলাম্বিয়ার ডেভিড এইচ হিকম্যান হাইস্কুল থেকে সর্বাধিক বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী বালক উপাধি লাভ করেন। স্যাম সবসময় তার পরিবারের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে চাইতেন। সেই আকাঙ্ক্ষা থেকে হাইস্কুল শেষ করে মিসৌরি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি একজন আরওটিসি (রিজার্ভ অফিসার্স ট্রেনিং কর্প) ক্যাডেটে পরিণত হন। সেসময় তিনি ছাত্র সংসদের সভাপতিও নির্বাচিত হন। স্যাম নির্বাচনে জয়ের জন্য এমন একটি ‘প্তরহস্য’ শেখেন যা পরবর্তীতে তাকে খুচরা ব্যবসা পরিচালনায় খুব সাহায্য করে। কৌশলটি ছিল ‘ফুটপাতে মানুষ তোমার সাথে কথা বলার আগেই তুমি তাদের সাথে কথা বলো’- স্যাম এই নিয়মটি মেনে চলতেন।


তিনি ক্যাম্পাসের সবার সাথে পরিচিত হওয়ার জন্য ঘুরে বেড়াতেন। ফলে অতি অল্পদিনেই বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশিরভাগ শিক্ষার্থী তাকে চিনে ফেলে এবং তাকে বন্ধু ভাবতে শুরু করে। এর সুফল হিসেবে স্যাম যে সংগঠনে যেতেন সেখানেই নির্বাচিত হতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় স্যামের খরচ চালানোর মতো যথেষ্ট আর্থিক সামর্থ্য তার পরিবারের ছিল না। তাই স্যামকে তার নিজের লেখাপড়া এবং থাকা খাওয়ার খরচ বহনের জন্য বিভিন্ন ধরণের কাজ করতে হতো। এ সময় তিনি ফ্রি খাবারের বিনিময়ে একটি রেস্টুরেন্টে ওয়েটারের দায়িত্ব পালন করতেন। পাশাপাশি তিনি পত্রিকা বিলি, ম্যাগাজিন বিক্রি এমনকি লাইফগার্ডের কাজও করেছেন। ১৯৪০ সালে স্যাম ওয়ালটন অর্থনীতিতে স্নাতক শেষ করেন।
এবার পুরোপুরিভাবে কর্মজীবনে ঢোকার পালা।


স্যামের প্রথম সত্যিকার চাকরি ছিল JCPenney নামের একটি দোকানের সেলসম্যান হিসেবে। স্যামের কাজ ছিলো জিনিসপত্র বিক্রি করা এবং হিসাব লিখে রাখা।
তাঁর হাতের লেখা এতই খারাপ ছিল যে ম্যানেজার বেশিরভাগ সময় তাঁর লেখা পড়তে পারতেন না। কিন্তু তারপরও তাঁকে দোকানে রাখতে হচ্ছিল, কারণ স্যাম ছিলেন একজন অসাধারণ সেলসম্যান।
এক পর্যায়ে জে.সি পেনির আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক ফিল ব্লেইক তাকে ডেকে বলেন, “ওয়ালটন, তুমি যদি একজন ভালো বিক্রয় কর্মী না হতে, তাহলে আমি তোমাকে চাকরি থেকে বরখান্ত করতাম। হতে পারে তুমি শুধুমাত্র খুচরা ব্যবসায় তোমার দক্ষতার কারণে বরখাস্ত হওনি।” এ থেকে বোঝা যায় স্যামের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই আদর্শ বিক্রয়কর্মীসুলভ গুণাবলী ছিল।


দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ওয়ালটন নিজের পাঁচ হাজার এবং শ্বশুরের কাছ থেকে ধার করা ২০ হাজার মার্কিন ডলারের বিনিময়ে বেন ফ্রাঙ্কলিন স্টোর ইজারা নেন। মূলত এটাই ছিল তার পরিচালনাধীন প্রথম স্টোর। স্যাম খুব দ্রুত শিখে ফেলেন যে উচ্চ মুনাফায় কম পণ্য বিক্রয়ের চেয়ে কম মুনাফায় বেশি পণ্য বিক্রয় করে অধিক লাভবান হওয়া যায়। ‘অধিক বিক্রয় অধিকতর মুনাফা নিশ্চিত করে’, — স্যামের এই নীতিটি পরবর্তীতে ওয়ালমার্ট চেইনের একটি মজবুত ভিত্তি গড়ে তোলে। পাঁচ বছরের মধ্যেই দ্যা বেন ফ্রাঙ্কলিন স্টোরের বার্ষিক বিক্রয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় আড়াই লাখ মার্কিন ডলার যার মধ্যে মুনাফার পরিমাণ ছিল ৪০ হাজার মার্কিন ডলার।


১৯৬০ সালের মধ্যে স্যামের ভ্যারাইটি স্টোরের সংখ্যা হলো দেড় ডজন। সে সময় তিনি বেন্টনভিলের একটি অফিস থেকে কোম্পানিটি পরিচালনা করতেন। আর ওইসময় ১,৮৫০ মার্কিন ডলারে নিজস্ব বিমান কেনেন স্যাম। বিমান কেনার পর স্যামের দোকান খোলার বাতিক পেয়ে বসলো। তিনি একে একে লিটল স্প্রিংডেইল, সিলোম স্প্রিংস, নিওডেসা কফিভিলে ফ্রাঙ্কলিন ফ্রাঞ্চাইজি খোলেন। প্রত্যেকটি স্টোরই ভিন্ন ভিন্ন অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে পরিচালিত হতো।কঠোর পরিশ্রমের পর অবশেষে স্যাম ওয়ালটন এমন একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যা খুচরা ব্যবসার চেহারাই পাল্টে দিয়েছিল। ১৯৬২ সালে প্রথম ওয়ালমার্ট স্টোর খুলতে সক্ষম হন স্যাম ওয়ালটন। এখনও এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় চেইনশপ বা সুপারস্টোর।


সবচেয়ে বড় চেইনশপ হওয়ার পাশাপাশি ওয়ালমার্ট এখনও বিশ্বের মধ্যে বিক্রি থেকে সবচেয়ে বেশি আয় (রেভিনিউ) করা কোম্পানি। ২০১৭ সালে ওয়ালমার্টের রেভিনিউ ছিলো ৪৮৬ বিলিয়ন ডলার। একই বছর স্টিভ জবস-এর অ্যাপলের আয় ছিল ২৫৫ বিলিয়ন ডলার। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে ওয়ালমার্টের ১১ হাজার ২৭৭টি স্টোর রয়েছে। ওয়ালমার্টে সব মিলিয়ে ২৩ লাখ লোক কাজ করেন। পৃথিবীর আর কোনও প্রাইভেট কোম্পানির এতো কর্মী নেই। প্রতিদিন গড়ে ওয়ালমার্টের স্টোরগুলোতে যত লোক পণ্য কিনতে যান, তা কানাডার মোট জনসংখ্যার (সাড়ে ৩ কোটি) চেয়ে বেশি।


১৯৮২ থেকে ১৯৯২ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত স্যাম ওয়ালটন বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি ছিলেন। ১৯৯২ এ তাঁর মৃত্যুর পরই বিল গেটস শীর্ষ ধনীর তালিকার এক নম্বরে আসতে পেরেছিলেন।
স্যাম ওয়ালটনের জীবনী থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে। জীবনে চলার পথে তার সবকিছুই আমাদের অনেক কিছু শিক্ষা দেয়।

সেতু ইসরাত,
উদ্যোক্তা বার্তা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here