সামাজিক উদ্যোক্তা- জাহাঙ্গীর আলম খান

বিশ্বায়নের এই যুগে প্রযুক্তির উৎকর্ষতা বেড়েই চলেছে তার সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলছে নেক্সট সেঞ্চুরির ডিজিজ গুলো। যেমন মানসিক সমস্যা, অবসাদ, হতাশা, স্থুলতা, অনিদ্রাসহ এমন অনেক অসংক্রামক রোগসমূহ। অফিসে কর্মরত প্রতিটি মানুষ কমবেশি এই অসুখ গুলো দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছে। আপাত দৃষ্টিতে এই রোগ গুলো দৃষ্টিগোচর হয়না বলে তাৎক্ষণিক কোন চিকিৎসা করা হয় না। তবে ভবিষ্যতে এই রোগ গুলো হতে পারে মহামারী আকারে আর এর থেকে পরিত্রাণের মহৎ উদ্যোগ নিয়ে কাজ করছেন সামাজিক উদ্যোক্তা জাহাঙ্গীর আলম খান।

পড়াশোনার পাশাপাশি উদ্ভাবনী কিছু করার ইচ্ছে ছিলো জাহাঙ্গীর আলম খানের। এসএসসি’র পরই পাড়ি জমান বিদেশে। কিন্তু মন বসছিলোনা প্রবাসে। দেশে ফিরে ভর্তি হলেন ইস্টওয়েস্ট ইউনিভার্সিটিতে। প্রথম দুবছর প্রোগ্রামিং এ মনযোগী হয়ে মোবাইল অ্যাপস ডেভেলপমেন্ট, ওয়েব প্রোগ্রামিং ইত্যাদি কাজে যুক্ত হয়ে দেশী বিদেশী বেশকিছু প্রজেক্ট সফলভাবে সম্পন্ন করেন। কিন্তু সব বাদ দিয়ে সমসাময়িক অসুখ গুলো ভাবিয়ে তোলেন তাকে। অফিসে কাজ করা মানুষদের ফ্রাস্টেশন, ডিপ্রেশন কমাতে কি স্বাস্থ্যসেবা দেয়া যায় তা নিয়ে কাজ করার খুব আগ্রহ থেকে ডিজিটাল  বিষয়ে একটি দক্ষ মেডিক্যাল টিম তৈরি করেন তিনি। যাত্রা শুরু হয় ‘মেডিটর হেল্‌থ’ এর।

মেডিটর হেল্‌থের প্রধান লক্ষ্য প্রযুক্তিনির্ভর ওয়েলবিয়িং সার্ভিস প্রদানের মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধ এবং স্বাস্থ্য উন্নয়নে কাজ করা; অর্থাৎ আমরা যেন সহজে অসুস্থ না হই, এবং আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ স্বাস্থ্য ঝুঁকি কমিয়ে নিয়ে আসতে পারি, পাশাপাশি শারীরিক ফিটনেস ও মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়নের মাধ্যমে সুস্থ ও কর্মক্ষম জীবন- যাপন করতে পারি সেই লক্ষ্য নিয়েই পুর্নাঙ্গ ওয়েলবিয়িং সেবা বা রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রনমূলক স্বাস্থ্য সেবা প্রদান করছে মেডিটর হেল্‌থ।

মেডিটর হেল্‌থ  এর সেবা সমূহের মধ্যে রয়েছে হেল্‌থ রিস্ক অ্যাসেসমেন্ট, স্মার্ট হেল্‌থ চেকআপ, ডায়েট এন্ড ফিটনেস প্ল্যান, মানসিক স্বাস্থ্য পরামর্শ এবং ডক্টর কনসালটেশন। কর্পোরেট কেয়ার, হোম কেয়ার এবং মোবাইল অ্যাপ এর মাধ্যমে মেডিটর কর্মক্ষেত্র, পরিবার ও ব্যক্তি পর্যায়ে রোগ প্রতিরোধ ও স্বাস্থ্য উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নির্ভর প্রযুক্তি, ডিজিটাল হেল্‌থ ডিভাইস, ইএমআর সফটওয়্যার এবং বিশেষ মনিটরিংয়ের মাধ্যমে মান সম্পন্ন স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করা। অন্যদিকে অভিজ্ঞ ডাক্তার, পুষ্টিবিদ, সাইকোলজিস্ট ও প্যারামেডিকদের নিয়ে গঠিত দক্ষ মেডিকেল টিম প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে প্রিভেনটিভ হেল্‌থ কেয়ার সার্ভিস প্রদানে সর্বদা নিয়োজিত রয়েছে।

বর্তমান পৃথিবীতে ৬৩% এর ও অধিক মানুষের মৃত্যুর প্রধান কারণ অসংক্রামক রোগসমূহ যার মধ্যে রয়েছে হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, ক্যান্সার, স্থুলতা, মানসিক সমস্যা ইত্যাদি। একদিকে জীবনের ঝুঁকি অন্যদিকে ব্যয়বহুল এই সকল রোগের চিকিৎসার ফলে অনেক মানুষই অর্থনৈতিকভাবে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে। তবে আশার কথা হলো, অসংক্রামক রোগসমূহ ৯০% এরও অধিক ক্ষেত্রে প্রতিরোধযোগ্য। আমাদের জীবনের এই গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা সমাধানের কথা চিন্তা করেই আধুনিক প্রযুক্তি ও অভিজ্ঞ চিকিৎসকদের সমন্বয়ে বিশ্বমানের প্রিভেনটিভ হেল্‌থ কেয়ার সার্ভিস প্রদানের লক্ষ্যে যাত্রা শুরু হয়েছে মেডিটর হেল্‌থ স্টার্টআপের।

২০১৮ সালের ১ লা জুলাই থেকে মেডিটর পরীক্ষামূলকভাবে সেবা প্রদান শুরু করে। এখন পর্যন্ত সফলভাবে ৩৫ টি প্রতিষ্ঠানের ১৫০০ এর বেশি কর্মীদের ওয়েলবিয়িং সার্ভিস প্রদানের পাশাপাশি ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় হেল্‌থ ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে ১২০০ এর বেশি মানুষকে প্রিভেনটিভ হেল্‌থ কেয়ার সার্ভিস প্রদান করতে সক্ষম হয়েছে। এছাড়াও মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে ৩,৫০০ এর অধিক মানুষ দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে অনলাইন ও অফলাইনে স্বাস্থ্যসেবা পেয়েছে। ফ্যামিলি বা হোমকেয়ার সার্ভিসটি এখনও গবেষণাধীন রয়েছে। আগামী কয়েকমাসের মধ্যেই ফ্যামিলি ওয়েলবিয়িং সার্ভিসটি চালু করার পরিকল্পনা রয়েছে। পরীক্ষামূলকভাবে সার্ভিস প্রদানের পাশাপাশি টেকসই ও বিশ্বমানের ওয়েলবিয়িং সার্ভিস প্রদানের লক্ষ্যে বেশ কয়েকটি স্বাস্থ্য বিষয়ক সংস্থার সাথে যৌথভাবে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করছে তারা।

মেডিটর হেল্‌থ স্টার্টআপের প্রতিষ্ঠাতা মোঃ জাহাঙ্গীর আলম খান এবং তার সাথে সহ-প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে রয়েছে ডাঃ শাফিউল ইসলাম এবং লুতফুন নাহার মুক্তা। উদ্যোক্তাদের মধ্যে জাহাঙ্গীর আলম খান একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার এবং ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা খাতে কাজ করার বেশ কয়েক বছরের অভিজ্ঞতা রয়েছে, অন্যদিকে শফিউল ইসলাম একজন এমবিবিএস ডাক্তার এবং জনস্বাস্থ্য খাতে কাজ করার বেশ কয়েক বছরের অভিজ্ঞতা রয়েছে। এছাড়াও উপদেষ্টা হিসেবে রয়েছে দেশের স্বনামধন্য বেশ কয়েকজন চিকিৎসক এবং সফল উদ্যোক্তা যাদের পরামর্শ এবং অভিজ্ঞতা উদ্ভাবন এবং ব্যবসাকে সঠিকপথে এগিয়ে নিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। অন্যদিকে অভিজ্ঞ ডাক্তার, পুষ্টিবিদ, সাইকোলজিস্ট ও প্যারামেডিকদের নিয়ে মেডিটর হেল্‌থের রয়েছে একটি দক্ষ মেডিকেল টিম; যারা বিশেষ ট্রেনিং প্রাপ্ত এবং যত্ন সহকারে মানসম্পন্ন স্বাস্থ্য সেবা আপনার পরিবার, প্রতিষ্ঠান এবং আপনার কাছে পৌঁছে দিতে সর্বদা প্রস্তুত রয়েছে।

মেডিটর হেল্‌থ মোবাইল অ্যাপটি গুগল প্লে-স্টোর থেকে ডাউনলোড করে বিনামূল্যে রেজিস্ট্রেশন করা যাবে। যার মাধ্যমে কর্পোরেট ও ফ্যামিলি কেয়ার সার্ভিস বুকিং করা যাবে এবং অভিজ্ঞ ডাক্তার, পুষ্টিবিদ ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়ার পাশাপাশি নিয়মিত হেল্‌থ মনিটরিং এর মাধ্যমে সুস্থ ও কর্মক্ষম জীবন যাপন করার সুযোগ তৈরি হবে।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে তিনি বলেন, আমরা আগামী ৫ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের ৫ হাজার প্রতিষ্ঠানের ২ লক্ষ কর্মী এবং ১ লক্ষ পরিবারের প্রায় ৪ লক্ষ সদস্য সহ ১০ লক্ষাধিক মানুষের কাছে আমাদের প্রিভেনটিভ হেল্‌থ কেয়ার সার্ভিস পৌঁছে দিতে চাই। এছাড়াও দেশের সেরা প্রিভেন্টিভ হেল্‌থ কেয়ার কোম্পানি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আমরা দেশের বাইরেও সেবা প্রদান করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে ভূমিকা রাখতে চাই। সেই লক্ষ্যে আমরা বাংলাদেশ সরকারের আইসিটি ডিভিশন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, বেসিস, বিজিএমইএ, ঢাকা সিটি কর্পোরেশনসহ বেশ কিছু সংস্থা সংগঠনের সাথে স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপের মাধ্যমে সফলভাবে বড় পরিসরে সার্ভিস প্রদানের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। আমরা বর্তমানে স্টার্টআপ বাংলাদেশ কো-ওয়ার্কিং অফিসে স্টার্টআপ বাংলাদেশের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে কাজ করে যাচ্ছি। পাশাপাশি বিভিন্ন এক্সিলারেটর প্রোগ্রামে অংশ নিচ্ছি এবং দেশী-বিদেশী ভেঞ্চার ক্যাপিটাল কোম্পানির সাথে যৌথভাবে বড় পরিসরে কাজ শুরু করার জন্য চেষ্টা করছি। আমরা বিশ্বাস করি, আমরা সরকার ও সংশ্লিষ্ট সংস্থা- সংগঠনের যথাযত সহযোগিতা পেলে বাংলাদশের স্বাস্থ্য সমস্যা সমাধানে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে সক্ষম হব এবং স্বাস্থ্যকর বাংলাদেশ নির্মাণের পথে এগিয়ে যেতে পারবো।

স্টার্টআপ বাংলাদেশ, আইসিটি ডিভিশন এবং ওয়াইগ্যাপ বাংলাদেশ এই উদ্যোগকে সফল করার
জন্য বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করছে। সামাজিক উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করায় সম্প্রতি ওয়াই গ্যাপের (Y-gap) এক প্রতিযোগিতায় সারাদেশ থেকে অংশগ্রহণ করা হাজার হাজার প্রতিযোগিদের মধ্যে সামাজিক উদ্যোক্তা জাহাঙ্গীর আলম খান প্রথম ১২তে স্থান করে নিয়েছেন। বাংলাদেশের সামাজিক উদ্যোক্তাদের স্বীকৃতি দিতে এবং তাদেরকে এগিয়ে নিতে ওয়াই গ্যাপ (ygap) কাজ করে চলেছে ২০১৬ সাল থেকে। এ পর্যন্ত তারা প্রায় ৭৫ জন সামাজিক উদ্যোক্তাকে স্বীকৃতি দিয়েছে।

 

 

বিপ্লব আহসান
স্পেশাল করেস্পন্ডেন্ট ,উদ্যোক্তা বার্তা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here