উদ্যোক্তা মৌসুমী আক্তার

কথায় আছে ‘অদৃষ্টের লিখন না যায় খন্ডন’ ভাগ্যে যদি কিছু লিখা থাকে সেটাকে উপেক্ষা করে উঠা যায় না তবে অদম্য ইচ্ছে এবং কাজ করার মানসিকতা থাকলে সেটাকে অনেকাংশেই কাটিয়ে নেয়া সম্ভব। তার জ্বলন্ত উদাহরণ আজকের এই সফল উদ্যোক্তা মৌসুমী আখতার।

মৌসুমী আখতারের ১২ বছরের ব্যবসা কিন্তু হঠাৎ করেই শারীরিক অসুস্থতা-রক্তের সমস্যা দেখা দেয়। অনেকটা ব্লাড ক্যান্সারের মতো। সম্পূর্ণরূপে ব্যবসা বন্ধ করে তাকে নিয়মিত ট্রিটমেন্ট করাতে হয়। কেটে যায় পাক্কা দু’বছর, ২০১৭-২০১৮ সাল। তারপর শারীরিক একটু সুস্থতা আসে। আড়মোড়া ভেঙে আবারো শুরু করেন কিন্তু ঠিক ছ’মাস বিধিবাম হঠাৎ করে ব্রেন স্ট্রোক, থেমে যায় সবকিছু।

তিলে তিলে গড়ে তোলা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান যখন দুম করে গুটিয়ে নিতে হয় তখন এর থেকে একজন উদ্যোক্তার জন্য কষ্টের আর কি বা হতে পারে। আপনি হলে কি করতেন? ভাবুনতো একবার!

এটা ২০১৯ সালের কথা। স্মৃতি শক্তির কার্যকারিতা কিছুটা লোপ পায় মৌসুমীর। কথা মনে রাখতে পারেন না। তবে এখন কিছুটা সুস্থ তাই আবারও শুরু করেছেন কিন্তু এর মাঝেই করোনা মহামারী। তবুও কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। অংশ নিচ্ছেন বিভিন্ন মেলাতেও।

তার উদ্যোক্তা জীবনের শুরুটা হয় ২০০৫ সালে। তখন বাবা-মা দুজনেই চাকুরিজীবী। ভাইবোনদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট এবং আদরের কন্যা মৌসুমী আখতার। রাজশাহীর মেয়ে হলেও মায়ের চাকুরির সুবাদে বড় হয়েছেন রংপুরে।

সবকিছু ভালোই চলছিল কিন্তু হটাৎ করেই মা অসুস্থ হয়ে পড়েন। আর পাঁচজনের মতো মৌসুমীর মাও ভাবলেন আমার কিছু হলে আমার মেয়ের কি হবে! এই নিয়মের হাত থেকে মৌসুমিও রেহায় পেলেন না। শৈশব না পেরুতেই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেন। তখন ক্লাস সিক্সের মেয়ে মৌসুমী।

তিন বছর পর মেয়ের মা হলেন এবং ক্লাস নাইনে পড়া অবস্থায় পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেল তার। মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। কিছু আর করার নেই এখন তাই পুরোদস্তুর গৃহিণী।

সবাই যখন প্রশ্ন করত ‘আপনি কি করেন’ তিনি বলতেন আমি টিপসই পাস। খুব খারাপ লাগত তার। ছোটবেলা থেকে দেখেছেন বাবা-মা দুজনই চাকুরি করেন কিন্তু তিনি পড়াশোনাই শেষ করতে পারেননি। ঘরে বন্দীজীবন কাটাতে হচ্ছিল। রান্নাবান্না এবং বাচ্চা সামলানোই যেন তার নিত্যদিনের সঙ্গী। উচ্ছ্বাসে ভরা মৌসুমীর যেন দম বন্ধ হয়ে আসে, কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না এই বন্দীদশা।

জেদ নিয়ে শুরু করলেন পড়াশোনা। শত ব্যস্ততাতেও পড়াশোনা চলছে, ডিগ্রি পরীক্ষা শেষে মাত্র দশ দিন পরেই জন্ম নিলো ছোট ছেলে।

সে সুবাদে রাজশাহীতে চলে আসলেন। মা একদিন বাজার করার জন্য ৫ হাজার টাকা দিলেন। বাজারেও গেলেন নিজের জন্য কিছু কিনবেন কিন্তু কি যেন মনে হলো তার।

নিজের কাপড় না কিনে কিনে আনলেন ১২ গজ কাপড়। অজান্তেই যাত্রা শুরু হলো উদ্যোক্তা জীবনের। বুটিক্সের কাজ জানত তার এক বান্ধবী। তার থেকে কিছু তথ্য নিয়ে ঐ ১২গজ কাপড়ে বুটিক্সের কাজ করলেন এবং ডেলিভারিও দিয়ে ফেললেন। ইচ্ছেতে কি’না হয়!

তীব্র ইচ্ছে যেখানে মুলধন তখন আর পিছু হাঁটা কেন! শুধুই এগিয়ে যাওয়া। মায়ের দেয়া সেই মাত্র ৫ হাজার টাকার পুঁজি নিয়ে যাত্রা শুরু হলেও এখন তার দুইটি প্রতিষ্ঠান। ‘গোধূলি বুটিক্স’ এবং ‘বিহঙ্গ ফ্যাশন হাউস’।

মৌসুমী আক্তার বলেন, ‘মনের এক কোনে ইচ্ছা ছিল নিজে আত্মনির্ভরশীল হবো, অসহায় মেয়েদের পাশে দাঁড়াবো। আজ মনে হয় পেরেছি কিছু। ৩শ মহিলার পাশে দাঁড়িয়েছি বিভিন্ন সময়ে এবং এখন আমার বেতন ভুক্ত কর্মী বন্ধু আছে মোট ১০ জন। সত্যি কথা বলতে কি জানেন, সমস্যা গুলোই আমার ব্যবসার মূলধন। পরিবারের সব সদস্যরা পাশে দাঁড়াননি মন থেকে, তারা চাননি আমি কিছু করি। যাতায়াতের সময় পাড়ার লোকজনও ফেরিয়ালি বলে বাজে শব্দ করত। শুধু পাশে ছিলেন মা’।

সফলভাবে সেই ১২পিস তৈরি পণ্য ডেলিভারি দেয়ার পর তার অনুপ্রেরণা বেড়ে যায় শতগুণ। তিনি আশেপাশের বিভিন্ন জায়গায় যান প্রশিক্ষণ নেন নিজেকে শক্ত অবস্থানে নিয়ে যান। পরবর্তীতে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন বিসিক, এসএমই ফাউন্ডেশনসহ অনেক প্রতিষ্ঠানে। পুরস্কৃত হয়েছেন অনেক যায়গায়। এসএমই বগুড়া জোন থেকে বর্ষসেরা নারী উদ্যোক্তার পুরস্কার পেয়েছেন। এভাবেই তিনি তার উদ্যোগকে এগিয়ে নিচ্ছেন।

নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য পরামর্শ কি থাকবে মৌসুমী আখতারকে এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘শুধু একটা কথাই বলবো, যদি আমি পারি তাহলে আপনি কেন নয়’?

তামান্না ইমাম
রাজশাহী ডেস্ক, উদ্যোক্তা বার্তা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here