২০০৬ সালে রাজশাহীর চারুকলায় ড্রয়িং এবং পেইন্টিং এ প্রথম বর্ষে পড়াকালীন অবস্থায় একটা ছোট্ট ব্যবসা করতে গিয়ে বেশ বড়সড় একটা লোকসানে পড়লেন। বলা যায়, শুরুতেই স্বপ্নভঙ্গ। দুই বান্ধবী মিলে ১ লক্ষ টাকার লেডিস ফতুয়া বানিয়েছিলেন, যিনি অর্ডার দিয়েছিলেন তিনি স্ট্রেইট বলে দিলেন অর্ডার ক্যান্সেল। পরিবার থেকে আসলো ভীষণ বাঁধা, কিন্তু তিনি হার মানতে চাইলেন না। উদ্যোক্তা হবার যুদ্ধ শুরু এখান থেকেই। আমাকে করতেই হবে এবং পারতেই হবে এমন ধনুক ভাঙ্গা পণ আত্মপ্রত্যয়ী উরশী মাহফিলা ফাতিহার। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন প্রথম বর্ষের ছাত্রী উরশী নিজের প্রচেষ্টায় পেলেন ২০০ পিস হ্যান্ড পেইন্ট শাড়ির অর্ডার। কিন্তু বাবার কড়া নিষেধ, আর করা যাবেনা এসব কাজ। আসলে এক লক্ষ টাকা লোকসান হবার পর কড়া নিষেধ থাকবে এটাই হয়তো স্বাভাবিক। কিন্তু লুকিয়ে লুকিয়ে প্রতি রাতে ৪টা করে শাড়ি হ্যান্ড পেইন্ট করতে হয়েছে উরশীকে। বৈশাখ উপলক্ষ্যে পাওয়া অর্ডারের ২০০ পিস শাড়ি ঠিক সময়ে ডেলিভারি দিতে হলে প্রতি রাতে ৪টা করে শাড়ির কাজ যে তাকে করতেই হবে। এই কাজে ১০ হাজার টাকা লাভ হলো আত্মপ্রত্যয়ী উরশীর, বাড়ল উৎসাহ। বিভিন্ন স্থানে গিয়ে প্রোডাক্ট স্যাম্পল দেখাতে শুরু করলেন। আসতে থাকলো অর্ডার, বাড়তে থাকলো বিক্রি।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়টাতে ভীষণ উদ্যমী ছিলেন উরশী। বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষে পড়াকালীন সময় প্রথম সেলস এক্সিবিশন করলেন উরশী। ১৫০ টির মতো পণ্য নিয়ে ৩ দিনের এক্সিবিশনে ১ লক্ষ বিশ হাজার টাকার সেলস উদ্যোক্তাকে জানান দেয় সম্ভাবনার কথা। ২০১১ তে দ্বিতীয় এবং ২০১৩ তে তৃতীয় এক্সিবিশন হলো। ৮X৮ ফিটের একটি শো রুম নিলেন উরশী। মাসে ৮০০ টাকা ভাড়া।
শো রুম দেবার পর উরশী দেখলেন একটি দুটি করে ডিজাইন করা পোশাক বা পণ্য বিক্রি করে এগিয়ে যাওয়া খুব একটা সম্ভব নয়। শুরু করলেন ডিজাইন তৈরির কাজ। রাজশাহী মহিলা কলেজের সামনে দিলেন ‘সীইজ’ হালের আউটলেট। ডিজাইনারস শোরুম হলেও উরশী স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছিলেন না তার শো রুমে। ডিজাইন কপি বা মেরিট ট্রেন হয়ে যাওয়াটাকে ভীষণ একঘেয়ে আর বিরক্তিকর মনে হচ্ছিলো তার। তাই ২০১২ সালে উরশী সিদ্ধান্ত নিলেন হোল সেল করার। স্বপ্ন দেখলেন নিজের শ্রম, ঘাম এবং মেধা দিয়ে তৈরি ডিজাইন যাবে দেশ বিদেশের সব জায়গায়।
লটে এবং হোল সেলে পুরো নতুন ফ্যাক্টরি আর পিয়ার কমিউনিকেশনস স্কিলকে অনেক বাড়িয়ে তুললেন উরশী। হোল সেলেই দিলেন সর্বোচ্চ গুরুত্ব । কাজের গতি বাড়ালেন ভীষণ, নিজে কাজ করার পাশাপাশি কাজ করাতেও শুরু করলেন বিভিন্ন অঞ্চলে। দারিদ্র নিপীড়িত এলাকা যেখানে কোন কর্মসংস্থান হবার প্রশ্নই ওঠে না এমন নিভৃত পল্লীতে শতশত নারী কর্মীকে ট্রেনিং দিয়ে সৃষ্টি করলেন কর্মসংস্থান।
বাগসারা, নওদাপাড়া, তানোড় হাটদহ, হাটরা মোহনপুর সহ এরকম ৮ থেকে ১০ টি অঞ্চলকে ভাগ করে ভিন্ন ভিন্ন টিম লিডার দিয়ে কাজ গোছাতে শুরু করলেন উরশী। বাড়তে থাকলো কাজের গতি। আত্মনির্ভরশীল হতে শুরু করলেন প্রত্যন্ত অঞ্চলের নারীরা। ভূমিকা রাখলেন দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে।
যেহেতু উরশী হোল সেলের লক্ষ্যস্থির করেছিলেন তাই শুরু করলেন বিভিন্ন মেলায় অংশগ্রহণ। ঢাকার বেইলী রোডে মাইডাস এর মেলা দিয়ে যাত্রা শুরু করে একে একে ২০১৩ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ৬৩ টি মেলায় অংশ নিলেন উরশী। ৭ টি মেজর ক্যাটেগরিতে আজ তার পণ্য তৈরি হচ্ছে। শাড়ি, সিল্ক, কটন, এবং এক্সক্লুসিভ কটন সালোয়ার কামিজ, সিঙ্গেল কামিজ, বেডশীট, নকশী কাঁথা, কুশন কাভার, পর্দা, ওড়না, শিকা, পুতুল সহ নানান রকম পণ্যে উরশীর ফ্যাক্টরীটি হয়ে উঠেছে ঝলমলে।
প্রতি মাসে বিভিন্ন অঞ্চলে কর্মীদের সুনিপুণ হাতে তৈরি হওয়া এক হাজার পিস ডিজাইন করা পণ্য উঠে আসে টিম লিডার আর ফ্যাক্টরী হয়ে হোল সেলের শোকেসে। বর্তমানে ফ্যাক্টরীতে প্রায় ১৫ জন এবং ১২ অঞ্চলে প্রায় ১২০০ জন কর্মী নিয়ে কাজ করছেন দৃঢ় প্রত্যয়ে বলিয়ান উদ্যোক্তা উরশী মাহফিলা ফাতিহা।