রাজশাহী সরকারি মহিলা কলেজের ৬০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে বর্ণাঢ্য আয়োজনে দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালায় পুনর্মিলনী অনুষ্ঠান-২০২৩ অনুষ্ঠিত হয়েছে। শনিবার (৪ ফেব্রুয়ারি) সকাল ১১টায় প্রধান অতিথি হিসেবে কলেজ চত্বরে জাতীয় পতাকা, কলেজ ও পুনর্মিলনীর পতাকা এবং বেলুন-ফেস্টুন ও পায়রা উড়িয়ে দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার উদ্বোধন করেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন।
এরপর কলেজ চত্বরে আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। শুরুতে প্রধান অতিথি রাসিক মেয়র খায়রুজ্জামান লিটনসহ অতিথিদের ফুলেল শুভেচ্ছা জানানো হয়। ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে’, ‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ সত্যসুন্দর’ এবং ‘জয় হোক, জয় হোক’ সুরের মূর্চ্ছনায় নৃত্যের তালে তালে অতিথিদের বরণ করে নেওয়া হয়। দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের মধ্যে আরো ছিল সকালে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা, বিকেলে স্মৃতিচারণ ও সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। পুনর্মিলনী অনুষ্ঠান প্রাক্তন ও বর্তমান ছাত্রীদের প্রাণের উচ্ছ্বাসে মিলনমেলায় পরিণত হয়।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে রাসিক মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন বলেন, সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মেট্রোরেলের উদ্বোধন করেছেন। সেই মেট্রোরেলের চালক ছিলেন একজন নারী। এটি নারীদের জন্য একটা গর্বের বিষয়। বিমানতো বহু আগে থেকে বাংলাদেশের মেয়েরা চালায়। মেয়েরা এখন ডিসি, এসপি, পুলিশ কমিশনার সবই হচ্ছে, এমনকি র্যাব, সেনাবাহিনী, বিজিবি সর্বত্র তারা সার্ভিস দিচ্ছে এবং দেশ গঠনে সামরিক-বেসামরিক উভয়ক্ষেত্রে নারীদের চমৎকার একটা উত্থান এই দেশে ঘটেছে। এ সবই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবদান।
মেয়র আরো বলেন: প্রায় একশ বছর আগে বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত বলেছিলেন, ‘তোমাদের কন্যাগুলিকে সুশিক্ষিতা করিয়া কার্যক্ষেত্রে ছাড়িয়া দাও, নিজেরাই নিজেদের অন্ন, বস্ত্র উপার্জন করুক।’আজকে তাই হয়েছে। নারীরা শিক্ষিত হচ্ছে এবং নিজেরা নিজেদের জায়গা করে নিচ্ছে। তারা পরবর্তীতে তার পরিবারের, সমাজের, আত্মীয়-স্বজনের এবং দেশের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করছে।
খায়রুজ্জামান লিটন বলেন, দীর্ঘদিন অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে ঘরে রাখার প্রবণতা আমাদের সমাজে ছিল। নানা কারণে ছিল, রক্ষণশীলতার কারণে ছিল, ধর্মীয় ভুল ব্যাখা দেওয়ার কারণে ছিল। সেই অর্ধেক জনগোষ্ঠী ঘরে বসে থেকে শুধু রান্না করে, বাচ্চার দেখাশোনা করে তাহলে তাদের যে মেধা আছে, দেশকে দেবার আছে, তাহলে সেটাতো নষ্ট হয়ে গেল, সেটাতো জাতি পেল না। সেই জন্য আমাদের নেত্রী শেখ হাসিনা আজকে মেয়েদেরকে উঠিয়ে নিয়ে আসছেন সর্বক্ষেত্রে।
রাসিক মেয়র আরো বলেন, দেশের সব জেলা শহরে বিশ্ববিদ্যালয় হবে। ইতোমধ্যে দেশের সকল উপজেলায় ছেলেদের এবং মেয়েদের জন্য কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হচ্ছে। পুঁথিগত যে জ্ঞান আমরা অর্জন করি সেটা তো থাকলো, পাশাপাশি হাতেকলমে কাজ শিক্ষা, যে শিক্ষা আমাদের ছেলে ও মেয়েদের স্বাবলম্বী হতে সাহায্য করবে, নিজের পাঁয়ে দাঁড়াতে সাহায্য করবে, সেই শিক্ষা প্রদানে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়েছেন। সেটি আমাদের ছেলে এবং মেয়েরা সমানভাবে গ্রহণ করছে।
রাসিক মেয়র বলেন, রাজশাহীতে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। রাজশাহীকে আমরা শিক্ষানগরী বলি। এখানে কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ঘাটতিও রয়েছে। রাজশাহীতে আমরা গালর্স ক্যাডেট কলেজ করতে চাই, যার বাস্তবতা এখানে রয়েছে।
অনুষ্ঠানে সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে বক্তব্য দেন বাংলা একাডেমির সভাপতি প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন। তিনি স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘৬০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে পুনর্মিলনীর এই অনুষ্ঠান আমাকে উদ্দীপিত করেছে। আমি এই কলেজের ১ম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলাম। কলেজ প্রতিষ্ঠার শুরুতে ছাত্রীদের ভর্তি করার জন্য খোঁজা হচ্ছিল। সে সময় আমি অন্য সরকারি কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম। তখন কলেজ প্রতিষ্ঠার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা আমাদের বাড়িতে এসে আমার বাবাকে আমাকে এই কলেজে ভর্তি করে দেওয়ার অনুরোধ করেন। বাবা তখন সেই অনুরোধ রাখেননি। যখন তারা আমাদের বাসা থেকে বেরিয়ে যান, তখন আমি দৌড়াতে দৌড়াতে তাদের কাছে গিয়ে বললাম, আমি আব্বাকে শান্ত করে এই কলেজে ভর্তি হবো, আপনারা আমাকে ভর্তি করে নিন। সেই কারণে আজকে এই অনুষ্ঠানে এসে আমার প্রাণের টান বলে অনুভূত হয়েছে। এই অনুভূবের জায়গাটিকে আলোকিত করায় জন্য যদি আর কিছু করার প্রয়োজন হয়, আমাকে বলেন, আমি আন্তরিকভাবে চেষ্টা করবো।’
অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন রাজশাহী সরকারি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর ড. জুবাইদা আয়েশা সিদ্দীকা। তিনি বলেন, রাজশাহীর সবচেয়ে প্রাচীন ও প্রথম নারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রাজশাহী সরকারি মহিলা কলেজ। নারী শিক্ষার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে কলেজটি। জাতীয় চার নেতার অন্যতম শহীদ এএইচএম কামারুজ্জামান এর পারিবারিক জমিদান এই কলেজ গড়ে উঠতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। এই কলেজের কৃতি শিক্ষার্থীরা দেশে-বিদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়ে কলেজকে করেছে মহিমান্বিত ও গৌরবান্বিত। সবাইকে এক জায়গায় গড়তে অ্যালামনাই এলামনাই এসোসিয়েশন গড়ে তোলা হয়েছে। সবাই একত্রে থেকে আগামীতে দেশ ও জাতির কল্যাণে কাজ করবে। আমাদের লক্ষ্য শিক্ষার্থীদের সোনার মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা।
অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য দেন রাজশাহী শিক্ষাবোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর তানবিরুল আলম, লেখক ও গবেষক ড. তসিকুল ইসলাম রাজা, প্রবীণ সাংবাদিক বীর মুক্তিযোদ্ধা মোস্তাফিজুর রহমান খান আলম, অনুষ্ঠানের আহবায়ক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ড. জান্নাতুল ফেরদৌস, রাজশাহী সরকার মহিলা কলেজের উপাধ্যক্ষ প্রফেসর ড. নাজনীন সুলতানা, শিক্ষক পরিষদের সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেন মোল্লা, কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও সঙ্গীত শিল্পী রিজিয়া পারভীন
এছাড়াও প্রতিষ্ঠানটির হীরক জয়ন্তী উপলক্ষে পুনর্মিলনীর আয়োজনে ছিলো উদ্যোক্তাদের উপস্থিতিও। রাজশাহী সরকারি মহিলা কলেজ থেকে পড়াশোনা শেষ করেছেন এমন প্রাক্তন এবং বর্তমানে অধ্যায়নরত রয়েছেন এমন শিক্ষার্থীরা খাবার, পোশাক, গৃহসজ্জা সামগ্রী, কাঠের তৈরি পণ্য, বৃক্ষ, লেদার গুডস আইটেমসহ বিভিন্ন ধরনের দেশীয় পণ্য নিয়ে তাদের স্টল সাজিয়েছিলেন। প্রাণের টানে মিলিত হওয়া এই উৎসব ঘিরে প্রতিটি স্টলের পণ্য ছিলো ছিল নাম মাত্র মূল্যে।
ডেস্ক রিপোর্ট
উদ্যোক্তা বার্তা