আমরা এমন একটি পৃথিবীতে বসবাস করি যেখানে লিঙ্গ বৈষম্য সমাজের একটি বড় ব্যাধি এবং প্রায় সর্বত্রই বিরাজমান। তবে আজ আমরা এমন একজন নারীর কথা জানবো, যিনি এই বাধাকে অতিক্রম করে পৃথিবীর শীর্ষ ধনীদের মধ্য জায়গা করে নিয়েছেন!
ইন্দ্রা নুয়ি ১৯৬৫ সালে ভারতের মাদ্রাজের একটি মধ্যবৃত্ত পরিবারে জন্মগ্রহন করেন। ছোটবেলা থেকেই উচ্চাকাঙ্গী ছিলেন এবং সবসময় চেষ্টা করতেন নিজের জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে নতুন কিছু করার। তিনি মাদ্রাজ ক্রিস্টান কলেজে ভর্তি হবার নারী ক্রিকেট টিমে যোগদান করেন এবং ব্যান্ডের সাথে গিটারিষ্ট হিসেবে নানান অনুষ্ঠানে যোগদান করতেন।
ছোটবেলা থেকেই মায়ের কাছ থেকে নানা বিষয়ে অনুপ্রেয়না পেতেন। তাকে সমসময় জিজ্ঞাস করতেন তুমি বড় হয়ে কি হতে চাও? যদি তার উওর মায়ের পছন্দ হতো তাহলে তাকে নানানভাবে পুরষ্কিত করতেন। এভাবেই সে প্রচন্ড আত্নবিশ্বাসী এবং দৃঢ়সংকল্পের মানুষে পরিণত হয়।
১৯৭৬ সালে ইন্দ্রা ব্যস্থাপনায় পি.জি. ডিপ্লোমা সম্পন্ন করেন। ১৯৭৮ সালে আমেরিকা পাবলিক ও প্রাইভেট ম্যানেজমেন্টের উপর মাস্টার্স করার জন্য ভর্তি হন। তখন তিনি নিজের খরচ চালাতে রাতে রিসেপশনিস্টের কাজ করা শুরু করেন।
মাস্টার্স শেষ করে দামি একটা স্যুট কিনে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে যান, তিনি বাদ পড়েন। তখন মন খারাপ করে প্রফেসর ইয়ালির কাছে যান পরামর্শ নিতে। তখন প্রফেসর বলেন, তুমি কোন পোশাকটি পরে স্বস্তি পাও সেটা পরে যাও ইন্টারভিউ দিতে। পরের ইন্টারভিউতে তিনি একটি শাড়ি পরে যান,আশ্চর্যভাবে তিনি ‘বোস্টন কনসাল্টিং গ্রুপে’চাকরিটি পেয়ে যান।
সেখানে তাকে বিভিন্ন বস্ত্র ও ভোগ্যপণ্য সংস্থা ,খুচরা বিক্রেতা এবং দীর্ঘস্থায়ী ক্লায়েন্টকে হ্যান্ডেল করতে হত। তার মতে, প্রাথমিক পর্যায়ে এটি বেশ কঠিন ছিল, কারণ প্রথমত সে একজন মহিলা এবং সে আমেরিকান ছিল না। ফলে তাকে তার যোগ্যতা প্রমানের তাকে বেশি কাজ করতে হত। কিন্তু সেটাকে সে নিজের উপর প্রভাব ফেলতে দেয়নি, পরিবর্তে, সে ভবিষ্যতের আশায় সেটার সৎ ব্যবহার করেছিলো।
১৯৮৬ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত প্রায় ছয় বছরের বেশি সময় পর তিনি মটোরোলার সহকারি সভাপতি এবং পরিকল্পনা পরিচালক হিসাবে নতুন কাজ শুরু করেন। তারপর তিনি ‘আসিয়া ব্রাউন বোভারি’ (এবিবি) তে যোগদান করেন সহকারি হিসেবে। এবিবিতে তার কার্যকালীন সময়ে এবিবি ব্যাপক সফলতা অর্জন করেন। তিনি এই ব্যবসা পরিচালনা করে ১০ বিলিয়ন ডলারের বিক্রিত পন্য থেকে বিক্রয়ের পরিমাণ ৩০ বিলিয়ন ডলারে নিয়ে যান। এই সাফল্যের সাথে, তিনি ব্যবস্থাপনায় ক্রমবর্ধমান তারকা হয়ে উঠেন।
১৯৯৪ সালে জ্যাক ওয়েলচ এবং ওয়েন ক্যালোওয়ে অনুরোধে তিনি পেপসিকোর সিনিয়র পরিকল্পনা পরিচালক হিসাবে যোগদান করেন।
সেই সময়ে, তিনি খেয়াল করলেন যে, পেপসিকোর সফট ড্রিকংস এবং ফিরোটো-লে মিলে ফ্রাইড খাবারের মতো প্রধান উপাদানগুলোর বিক্রয়ের পরিমাণ দিন দিন কমে যাচ্ছে এবং ভোক্তারা আস্তে আস্তে স্বাস্থ্যসম্মত খাবারের দিকে ঝুঁকছে।
তখন তিনি চিন্তা করলেন প্যাকেটযুক্ত খাবার বিক্রি করার এবং খেয়াল রাখলেন খাবারে মান ভালো করার। ইন্দ্রার জন্য কোম্পানিটা বড় রকমের সমস্যার হাত থেকে রেহাই পায়।
ইন্দ্রার এই চিত্তাকর্ষক প্রতিভা দেখে, তাকে ২০০০ সালে চীফ ফাইন্যান্সিয়াল অফিসার পদে উন্নীত করা হয়। ২০০৬ সালে অক্টোবরে ইন্দ্রাকে কোম্পানির সিইও করা হয়। যদিও তিনি ২০০৭ সালের এপ্রিল পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট হিসাবে অব্যাহত ছিলেন।
ইন্দ্রা পেপসিকোর প্রধান নির্বাহী হিসেবে যোগ দেবার পর পেপসির আয় বছরে সাড়ে তিন হাজার কোটি ডলার থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার কোটি ডলারের ওপরে। সেসময় থেকে পুঁজিবাজারে পেপসির শেয়ারের দাম বেড়েছে ৮০ শতাংশ।
“কোন প্রতিষ্ঠানের প্রধান হওয়া আসলে কোন চাকরির মত করে করা উচিত নয়। এটা কোনো কাজের প্রতি অন্তরে অনুভূত হওয়া এক ধরণের আহ্বান। আর সেই আহ্বানে সাড়া দিতে আপনি মাথা, হৃদয় এবং হাত নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। আপনি যা করছেন তা আপনাকে ভালবাসতে হবে, আর সেটি আপনাকে একেবারে গ্রাস করে নেবে।”
ব্যবসায়িক দুনিয়ায় ইন্দ্রা নুয়ি ছিলেন খুবই বিরল একটি উদাহরণ। একজন অভিবাসী এবং একজন নারী হওয়া সত্ত্বেও তিনি গত ১২ বছর যাবৎ পেপসিকোর প্রধান নির্বাহী হিসেবে কাজ করেছেন।
“আপনি এখন একজন রোল মডেল। ফলে সবাই তখন আপনার কাজ দেখছে, এবং এসব কাজ খুবই কঠিন। কারণ এজন্য আপনাকে খুবই সতর্ক থাকতে হবে সব সময়”, ২০১১ সালে বিবিসির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেছিলেন নুয়ি।
“কোন ধরণের বাড়তি সুবিধা কিংবা সাজপোশাক- এগুলো কখনো মাথায় জায়গা দেবেন না। নিজের পা সব সময় মাটিতেই যেন থাকে, আর নিজের পদের দায়িত্ব পালনে পুরোটা মনোযোগ দেয়া-এটুকুই করি আমি।”
বর্তমানে বিশ্বব্যাপী খাদ্য ও পানীয়গুলির যৌথ পোর্টফোলিওতে পেপসিকো ২২ টি ব্র্যান্ডে উন্নীত হয়েছে, যার মধ্যে কয়েকটি রয়েছে যেমন, কাকার, ট্রপিকানা, গেটোরেড, ফ্রেটো-লে এবং পেপসি-কোলা। ইন্দ্রার জন্য পেপসিকোর মোট মুনাফা ২০১৪ সালে ২.৭ বিলিয়ন ডলার থেকে ৬.৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছিল।
বর্তমানে কোম্পানিটি ৬৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের রাজস্ব আয় করেছে এবং এটি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম খাদ্য ও পানীয় কোম্পানি তৈরি করছে।
১৪৪ মিলিয়ন ডলারের নেট মূল্যের সাথে ইন্দ্রা ১৮.৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বার্ষিক বেতন অর্জন করে এবং বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ শক্তিশালী মহিলাদের মধ্যেও ধারাবাহিকভাবে স্থান পায়।
২০১৪ সালে, তিনি ফরচুন বিজনেসে ৩য় সর্বাধিক শক্তিশালী নারী হিসাবে নামকরণ করেছিলেন।
২০১৮ সালের জুন মাসে ইন্দ্রা নুয়িকে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিল (আইসিসি) বোর্ডের প্রথম স্বাধীন নারী পরিচালক হিসেবে যোগ দেন।
বর্তমানে তিনি ফোর্বসের বিশ্বের ১০০ টি শক্তিশালী নারী তালিকাতে ১৫ তম অবস্থানে আছেন।ভারতের রাষ্ট্রপতি তাকে “পদ্মা ভূষণ” (তৃতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার) প্রদান করেছেন।
মোঃ হৃদয় সম্রাট