বৃদ্ধাশ্রমের যাত্রার ইতিহাস বহু বছর আগের। ঘরছাড়া অসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্রের এই উদ্যোগ ছিল শান রাজবংশের। খ্রিষ্টপূর্ব ২২০০ শতকে পরিবার থেকে বিতাড়িত বৃদ্ধদের জন্য আলাদা এই আশ্রয়কেন্দ্র তৈরি করে ইতিহাসে আলাদা জায়গাই দখল করে নিয়েছে এই শান রাজবংশ। পৃথিবীর প্রথম প্রতিষ্ঠিত সেই বৃদ্ধাশ্রমে ছিল বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের আরাম-আয়েশের সব রকম ব্যবস্থা। ছিল খাদ্য ও বিনোদন ব্যবস্থা।

মানবিক ও সামাজিক উদ্যোক্তা মিলটন সামাদ্দার

তবে এখনকার দিনে বৃদ্ধাশ্রম হয়ে উঠছে দায়িত্ব এড়ানোর হাতিয়ার। আর্থিকভাবে সচ্ছল সন্তান নৈতিকতার অবক্ষয়ের চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত স্থাপন করে পিতা-মাতাকে এক অর্থে ত্যাগ করে ফেলে যাচ্ছে রাস্তায়, জঙ্গলে অথবা আশ্রমে। এককালের একান্নবর্তী পরিবারগুলো ভেঙে যাচ্ছে, আর তাতে স্থান হচ্ছে না বৃদ্ধ পিতা-মাতার। যে বাবা-মা একসময় নিজে না খেয়েও সন্তানকে মুখে তুলে খাইয়ে দিতেন, তারা আজ কোথায় কেমন আছেন, সেই খবর নেয়ার সময় যার নেই তার নিজের সন্তানও হয়তো একদিন তার সাথে এমন আচরণই করবে।

১. চাইল্ড এন্ড ওল্ড এজ কেয়ার (বৃদ্ধাশ্রম)।

উদ্যোক্তা মিলটন সামাদ্দার তৈরি করেছেন চাইল্ড এন্ড ওল্ড এজ কেয়ার (বৃদ্ধাশ্রম)। কল্যাণপুর, মিরপুরে গড়ে তোলেন তার এই স্বপ্ন প্রতিষ্ঠান। জীবনের শেষ বেলায় এসে সহায়সম্বলহীন মানুষগুলো চাইল্ড এন্ড ওল্ড এইজ কেয়ারে পান মাথা গোঁজার ঠাঁই। শুধু বৃদ্ধ-বৃদ্ধা নয় অভিভাবকহীন অসুস্থ প্রতিবন্ধী শিশুরাও আশ্রয় পেয়ে থাকেন এখানে। পৃথিবীর এই দুর্দিনেও অসহায় মানুষগুলোর পেছনে ছুটে বেড়ান মানবিক ও সামাজিক উদ্যোক্তা মিলটন সামাদ্দার।

এই বৃদ্ধাশ্রমটি প্রতিষ্ঠা হয় ২০১৪ সালে। বর্তমানে এই বৃদ্ধাশ্রমে রয়েছেন মোট ১২৫ জন। তাদের মধ্যে শুধু বৃদ্ধ-বৃদ্ধা আছেন ৮৭ জন। শিশু ও বাক প্রতিবন্ধি আছে ১৪ জন, অবশিষ্টরা হলেন বৃদ্ধাশ্রমের কর্মচারী, তাদের সেবায় কর্মরত রয়েছেন পুরুষ,মহিলা সেবাকর্মী এবং প্রশিক্ষিত নার্স। চিকিৎসা সেবার জন্য রয়েছেন একজন অভিজ্ঞ ডাক্তার। ডাক্তার শাহরিয়ার নাজিম পার্থ (এম.বি.বি.এস) তিনি সপ্তাহে ২ দিন এই বৃদ্ধ বাবা-মা’দের চিকিৎসা সেবা প্রদান করেন। রান্নার কাজে রয়েছেন ২ জন রাঁধুনী।

বৃদ্ধাশ্রমের পরিচালক মিল্টন সামাদ্দার এর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত ছয় বছর ধরে তিনি এই বৃদ্ধাশ্রমটি পরিচালনা করে আসছেন। তিনি আরও জানান, আমার একটি নার্সিং হোম সার্ভিস আছে সে হোম সার্ভিস থেকে প্রতিমাসে প্রায় ৫ লক্ষ টাকা উপার্জন হয়। এ উপার্জনের টাকা থেকে আমি প্রথমে একজন অসহায় ব্যক্তিকে সাহায্যে করা শুরু করি। পরবর্তীতে সদস্য সংখ্যা বেড়ে গেলে বৃদ্ধাশ্রমের জন্য বাড়ি ভাড়া নিয়ে অসহায় বৃদ্ধ বাবা-মা সংগ্রহ করা শুরু করি। মানবিক কারণেই বৃদ্ধাশ্রমটি পরিচালনা করেন বলেও জানান তিনি। উদ্যোক্তা মিলটন বলেন, “এই সকল অসহায় প্রতিবন্ধী শিশু এবং বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের পরিবার পরিজন নেই। এদের কেউ থাকতো রাস্তায়, মাজারে, কেউ বা বস্তির কুঁড়ে ঘরে। এদের মধ্যে অনেকে বিভিন্ন বার্ধক্য জনিত কঠিন রোগে আক্রান্ত। আমি মনে করি এই সকল বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে প্রতিপালন করা আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য”।

সেই দায়িত্ব ও কর্তব্য থেকে চাইল্ড এন্ড ওল্ড এজ কেয়ার প্রতিনিয়ত কাজ করছে। অধিকাংশ শিশু ও বৃদ্ধ-বৃদ্ধাই অসুস্থ, নিজ থেকে হাটা চলাফেরা করতে এবং কোন কাজ করতেই সক্ষম নয় তারা। তাদের পরিচর্যা করা, কর্মচারীদের মাসিক বেতন, হঠাৎ করে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের কেহ গুরুতর অসুস্থ হলে তাহার চিকিৎসা ও হাসপাতালের ব্যয়ভার বহন এমনকি তাদের সুস্থ রাখতে সর্বদা মানসম্পন্ন পুষ্টিকর খাবার দেয়া ওষুধ, পোশাক ও বিছানাপত্র, তাদের পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা এমনকি মৃত দেহের দাফন কাফন সহ সকল প্রকার সহায়তা প্রদান করেন তারা।

প্রতিদিন ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-ছাত্রী, সরকারি প্রশাসনিক কর্মকর্তা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, পাশাপাশি চাকুরীজীবি পরিবারের সদস্যরা খাবার ও অর্থ সহযোগিতা দিয়ে যান এই বৃদ্ধাশ্রমে।

বৃদ্ধাশ্রম চেয়ারম্যান ও পরিচালক মিল্টন সামাদ্দার আরও জানান, বর্তমানে আমি সমাজের বিভিন্ন স্তরের ব্যক্তিবর্গের সহযোগিতা পেয়ে থাকি। উনারা প্রতিমাসে এখানে টাকা দিয়ে রশিদ নিয়ে যায়। প্রতিমাসে খাবারের অভাব হয়না এই বৃদ্ধাশ্রমে। অনেকে প্রতি সপ্তাহে আবার অনেকে প্রতিদিন খাবার দিয়ে যায় এই বৃদ্ধাশ্রমে। আমার স্ত্রী আমাকে প্রতিষ্ঠানটির তত্ত্বাবধানে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন।

রাস্তা থেকে তুলে আনা অসুস্থ মানুষদের নিয়েই এই বৃদ্ধাশ্রম। মিরপুরের কল্যাণপুরের দক্ষিণ পাইকপাড়ায় অবস্থিত এই ‘চাইল্ড এন্ড ওল্ড এইজ কেয়ার’ অন্য বৃদ্ধাশ্রমগুলো থেকে ভিন্নধর্মী। প্রথম দিকে রাস্তায় থাকা অসহায় বৃদ্ধদের নিয়েই শুরু হয়েছিল এর যাত্রা। বর্তমানে এখানে ১২৫ জনকে নিয়েই মিল্টনের পরিবার।

২. বৃদ্ধাশ্রম থেকে বিনামূল্যে শিশুদের কোরআন শিক্ষা:
বৃদ্ধাশ্রমের সেবা দানের পাশাপাশি এলাকার শিশুদের ইতিবাচক নিয়ম শৃঙ্খলা, ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধভিত্তিক জ্ঞান বৃদ্ধির জন্য এই প্রতিষ্ঠান এর পক্ষ থেকে বিনামূল্যে শিশুদের পবিত্র কোরআন শিক্ষা দেয়া হয়। শারীরিক, মানসিক ও নৈতিক সুশিক্ষায় সঠিকভাবে গড়ে তুলতে শিশুদের জন্য ধর্মীয় শিক্ষা সমাজ ও পরিবারে কার্যকর ভূমিকা রাখার ক্ষেত্রে চাইল্ড এন্ড ওল্ড এজ কেয়ার (বৃদ্ধাশ্রম) উদ্যোগ প্রশংসার দাবি রাখে।

৩. বৃদ্ধাশ্রমের নতুন ঠিকানা “কমলাপুর”

অনেকদিন ধরেই মিলটন সামাদ্দার চাচ্ছেন একটি জমি, যেখানে আর ভাড়া বাসায় থাকতে হবে না। নিজের মতো সাজিয়ে সেখানেই তিনি এসব মানুষকে রাখতে পারবেন। অবশেষে তার সেই চাওয়া পূরণ হয়েছে- সাভারের বিরুলিয়া এলাকায় কমলাপুর গ্রামে ২৫ শতক জমি বৃদ্ধাশ্রমের নামে কেনা হয়েছে । ইতিমধ্যে জমির সয়েল টেস্ট হয়ে গেছে। বিল্ডিং এর প্ল্যান ও পাশ হয়ে গেছে। পাঁচ তালা ফাউন্ডেশন দিয়ে তিন তোলা পর্যন্ত কমপ্লিট করার জন্য দ্রুত কাজ শুরু হবে বলে জানান বৃদ্ধাশ্রমের সুপারভাইজার।

এই প্রসঙ্গে মিলটন সামাদ্দার বলেন, ‘তখন আমি আপনাদের সবার সহযোগিতা চাইবো। হয়তো একজন মানুষ অনেককিছু দিতে পারবে না, কিন্তু একজন যদি একবস্তা সিমেন্ট, কেউ যদি দশটা ইট দিয়েও আমাকে সাহায্য করেন তাও অনেক।

৪. বাড়ি ফেরার ‘স্বপ্ন’ দেখেন না তাঁরা

মানুষের বয়স বাড়তে থাকলে তাঁরা একাকীত্বে ভোগেন। এই সময় পাশে কাউকে দরকার হয়। উদ্যোক্তা মিলটন সামাদ্দার “চাইল্ড এন্ড ওল্ড এজ কেয়ার” (বৃদ্ধাশ্রম)-এ সেই কাজটাই করে থাকেন। মূলত চার রকম সমস্যার সম্মুখীন হয়ে মানুষ একটা বয়সের পর বৃদ্ধাশ্রমে আসেন। সমস্যাগুলো হল, ছেলে মেয়ে বিদেশ থাকে, কেউ বিয়ে করেননি, কারও মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছে, কেউ আবার পারিবারিক সমস্যার সম্মুখীন। কেউই স্বেচ্ছায় নিজের হাতে তৈরি সংসার ফেলে আসতে চান না।

অসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা বৃদ্ধাশ্রমকেই নতুন সংসার মেনে নিয়েছেন। তাই এখানকার মতো করেই দিন-রাত্রি উপভোগ করতেই তাঁরা অভ্যস্ত। আর বাড়ি ফেরার ‘স্বপ্ন’ দেখেন না তাঁরা। এখানেই সবার একসাথে মিলে মিশে দিন-রাত্রি কেটে যায়।

উজ্জ্বল চোখে, আকার ইঙ্গিতে, জড়ানো কণ্ঠে, অব্যাক্ত শরীরী ভাষায় প্রতিটি বৃদ্ধাশ্রমের একটাই গল্প – এখন যে ক’দিন বেঁচে থাকা সে ক’টা দিন একরাশ যন্ত্রণা বুকে নিয়ে পরপারের অপেক্ষায়।

আমাদের মনে রাখা উচিত- আজ যিনি সন্তান, তিনিই আগামী দিনের বাবা কিংবা মা। বৃদ্ধ বয়সে এসে মা-বাবারা যেহেতু শিশুদের মতো কোমলমতি হয়ে যান, তাই তাদের জন্য সুন্দর জীবনযাত্রার পরিবেশ তৈরি করাই সন্তানের কর্তব্য। আর যেন কখনো কোনো বাবা-মার ঠিকানা বৃদ্ধাশ্রম না হয়, তা সুনিশ্চিত করতে সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ, রাজনীতিবিদ, প্রচারমাধ্যম সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। তাদের জন্য তৈরি করতে হবে একটা নিরাপদ ও সুন্দর পৃথিবী।

ডেস্ক রিপোর্ট, উদ্যোক্তা বার্তা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here