উদ্যোক্তা- আবুল মিয়া

কৃষি ব্যবস্থা একটি বহুমুখী কর্মধারার সমন্বয়। বাংলাদেশের জিডিপি প্রায় এক-চতুর্থাংশই বর্তমানে কৃষি সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত। কৃষি সেক্টরের মধ্যে শুধুমাত্র শস্য ক্ষেত্রে এর অবদান কৃষি জিডিপির প্রায় ৬০ শতাংশ। কৃষি প্রযুক্তি কৃষি সেক্টরের উন্নয়নের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বীজ, সার ও কীটনাশক, পানি ব্যবস্থাপনা এবং কৃষি যন্ত্রপাতিই মূলত দেশে ব্যবহৃত কৃষি প্রযুক্তি। এর মধ্যে কৃষি যন্ত্রপাতি তথা কৃষি যান্ত্রিকীকরণ অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি। নানা সমস্যা ও সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও কৃষি যান্ত্রিকীকরণের ফলে দেশের শস্য উৎপাদন বিগত ২৫ বছরে প্রায় দ্বিগুণেরও বেশি অর্জন সম্ভব হয়েছে।

বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন যে, উন্নত কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রযুক্তি প্রয়োগে শস্য উৎপাদনের কারিগরি দক্ষতা বৃদ্ধি ও প্রাপ্ত সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার ও ফসল কর্তনোত্তর ক্ষতি কমানোর মাধ্যমে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব।

আমাদের দেশে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় দেশীয় কলাকৌশল রপ্ত করে নানা ধরনের দেশীয় উপযোগী কৃষি যন্ত্রপাতি তৈরির চেষ্টা বেশ লক্ষণীয়। কৃষি যন্ত্রপাতি তৈরির অগ্রযাত্রায় সিলেটের মো. আবুল মিয়ার নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখ করতে হয়।

আবুল মিয়া কৃষি উপযোগী যে যন্ত্রটি তৈরি করেছেন, তার নাম ‘পাওয়ার টিলার’। যন্ত্রটি দিয়ে কৃষি জমি চাষ করা হয়। এই যন্ত্রটি আবুল মিয়া প্রথমে বাজারজাত করেন ২০১০ সালে বোরো মৌসুমের শুরুতে। সহজে ব্যবহারের উপযোগী এবং দাম তুলনামূলক কম হওয়ায় সিলেট অঞ্চলের কৃষকদের কাছে যন্ত্রটি পরিচিতি পায় ‘আবুল মেশিন’ নামে।

কাজের স্বীকৃতি হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেয়েছেন আবুল মিয়া। পেয়েছেন ‘বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার’। যা কিনা ২০১২ সালের ২৯ এপ্রিল ঢাকার ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে আবুল মিয়ার হাতে প্রধানমন্ত্রী জাতীয় এই পুরস্কার আবুল মিয়ার হাতে তুলে দেন। এছাড়াও পেয়েছেন রাষ্ট্রপতির শিল্প উন্নয়ন পুরস্কার -২০১৬।

সিলেটের দক্ষিণ সুরমার চর মোহাম্মদপুর গ্রামে আবুল মিয়ার বাড়ি। পরিবারে বাবা নেই, তাই সংসারের হাল ধরতে দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করে ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপে কাজ নেন। কিন্তু পরিবার চালানোর মতো আয় ভালো হচ্ছিলো না । উন্নত জীবনের আশায় পাড়ি দেন সৌদি আরব। কৃষি যন্ত্রপাতি তৈরির কারখানায় এক বছর ১৮ মাস কাজ করে রপ্ত করেন কৃষি যন্ত্রপাতি তৈরির নানা কৌশল। এক সময় দেশে ফিরে বাড়ির সামনে ‘আবুল ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস’ নামে একটি কৃষি যন্ত্রাংশ তৈরি ও বিক্রির ব্যবসা শুরু করেন।

উদ্যোক্তা বলেন- “মানুষ বিদেশ থেকে টাকা নিয়ে ফেরে। আমি ফিরেছি কাজ শিখে। বিদেশ থেকে দেশে ফেরার সময় ওই কারিগরি শিক্ষাটাই ছিল আমার মূল পুঁজি, তখন আমার হাতে ছিল ৩০০ টাকা। যা দিয়ে ‘আবুল ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস’ এর যাত্রা শুরু হয়”।

আবুল মিয়া তাঁর তৈরি যন্ত্র ব্যবহারে কৃষকদের সাড়া দেখে নতুন যন্ত্র তৈরির কাজে মনোনিবেশ করেন। ১৯৯৯ সালে বোরো মৌসুমে উদ্যোক্তা তৈরি করেন ধান মাড়াইয়ের কল। এরপর প্রান্তিক কৃষকদের জন্য ধান মাড়াইয়ের কলকে ছোট আকৃতি দিয়ে তৈরি করেন। যা বাজারে ব্যাপক প্রচলিত ও প্রশংসিত ।

সময়ের পথ পরিক্রমায় ২০০৪ সালে ‘আবুল ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস’ পরিণত হয়ে যাত্রা শুরু করেন ‘আবুল ইন্ডাস্ট্রিজ’ এ। বর্তমানে আবুল ইন্ডাস্ট্রিজে নিয়মিত ১১ জন ও অনিয়মিত ১৯ জন শ্রমিক কাজ করছে।

আবুল ইন্ডাস্ট্রিজে তৈরী করা হয় খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ মিকচার মেশিন, ব্লেন্ডার মেশিন ও পাওয়ার টিলার মেশিন। ২০০৫ সালে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বিভিন্ন কৃষি যন্ত্রাংশ প্রদর্শনী মেলায় আবুলমিয়া তাঁর পাওয়ার টিলার প্রদর্শন করে পরবর্তী বছর থেকে বাজারজাত শুরু করেন। উদ্যোক্তার তৈরি যন্ত্র কৃষকদের কাছে দিন দিন জনপ্রিয়তা লাভ করতে থাকে। দেশীয় প্রযুক্তি ও দামের দিক দিয়ে সাশ্রয়ী হওয়ায় উদ্যোক্তার যন্ত্র পুরস্কৃত হয়।

‘আবুল মেশিন’ নামে পরিচিত পাওয়ার টিলার যন্ত্র তৈরিতে একেকটিতে মোট ১৫৫ কেজি লোহার দেশীয় কাঁচামালের প্রয়োজন পড়ে। পাইপ, অ্যাঙ্গেল, শিট ও পাত-এই চার রকমের উপকরণ লাগে। এসব কাঁচামাল ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে কেনা হয়। একেকটি যন্ত্র একজন কারিগরের তত্ত্বাবধানে তিনজন কর্মী মিলে ছয় দিনে তৈরি করতে সক্ষম। প্রতিটি যন্ত্রের ওজন প্রায় ১৬৫ কেজি। এই যন্ত্র মাটির নয় সেন্টিমিটার গভীর পর্যন্ত খুঁড়তে সক্ষম।উদ্যোক্তা জানান তাঁর তৈরি যন্ত্র নিরবচ্ছিন্ন ভাবে আট বছর সচল থাকবে ।

পরিশেষে উদ্যোক্তা বলেন- “কৃষি যান্ত্রিকীকরণ ও অবকাঠামোগত উন্নয়নকে একসূত্রে বেঁধে সনাতন পদ্ধতি থেকে বের হয়ে প্রযুক্তিনির্ভর কৃষি ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশের কৃষি ক্ষেত্রে শস্য উৎপাদন থেকে শুরু করে বাজারজাত, প্রক্রিয়াজাত এবং মত্স্য ও পশু সম্পদ খামারের আরো আধুনিকীকরণের জন্য প্রয়োজন কৃষি যন্ত্রের আধুনিকায়ন ও বহির্বিশ্বের সাথে প্রযুক্তিগত ও প্রয়োগ গত দিক থেকে তাল মিলিয়ে চলা। তাহলে কৃষি খাত দেশের জিডিপিতে রাখতে পারবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা”।

ডেস্ক রিপোর্ট, উদ্যোক্তা বার্তা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here