সামাজিক উদ্যোক্তা- ওয়াহিদ হোসাইন

বাংলাদেশের ঐতিহ্য সংস্কৃতি সমাদৃত হচ্ছে বিশ্বদরবারে। কর্মসংস্থান হচ্ছে নারীদের, উন্নত হচ্ছে তাদের জীবন যাত্রার মান। আর এভাবেই প্রতিদিন কমে আসছে নারীদের অসহায়ত্বের গল্প। শত শত অসহায় পরিবারের মুখে হাসি ফোটানো এবং দেশকে তুলে ধরার এই আপ্রাণ চেষ্টায় কাজ করে চলেছেন যারা তাদেরই একজন ওয়াহিদ হোসাইন।

‘টাইগার বো’ এর প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও ওয়াহিদ শুরুতে বাংলাদেশের প্রায় সকল তরুণের মতো স্বপ্ন দেখতেন ভালো একটা চাকরি, অনেক উপার্জন এবং সুন্দর একটা জীবন যতোক্ষণ না সাবিনা চৌধুরীর সাথে তার দেখা হয়। সাবিনা একজন কারিগর যিনি বিছানার কভারে এবং বিভিন্ন পোশাকে বাংলাদেশের কৃষ্টি সংস্কৃতি তুলে ধরেন এবং সেগুলো বিক্রির মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করেন।

একদিন পোশাক ডেলিভারি দিতে আসে ওয়াহিদের মায়ের কাছে। সেই সূত্রে ওয়াহিদ তার সাথে কথা বলে জানতে পারেন এতো সুন্দর কাজ করার পরেও তার উপার্জন মাসে মাত্র ৮ হাজার টাকার মতো। যা সুন্দর ভাবে জীবন ধারণের জন্য অপ্রতুল। তাই ওয়াহিদ তাকে গার্মেন্টসে যোগদানের জন্য পরামর্শ দিলেন।

সাবিনা খুব স্পষ্ট এবং গর্বের সঙ্গে বলেন ‘আমি গার্মেন্টসে চাকরি করবো না বরং আমি বাংলাদেশের কৃষ্টি সংস্কৃতি তুলে ধরছি এবং এটাই করবো। তাতে সবাই আমাদের দেশ সম্পর্কে জানতে পারবে। আপনারা জানতে পারছেন, দেখতে পারছেন। কিন্তু এমন কাজ না করলে জানবেন কিভাবে?

এই প্রশ্নটা শুনে ওয়াহিদ থমকে যায়। ঠিক তখনই বাংলাদেশের যুবকদের সেই চিরাচরিত স্বপ্ন একটা ভালো চাকরির গন্ডি থেকে বেড়িয়ে আসেন। সমাজ উন্নয়ন এবং দেশকে তুলে ধরার প্রচন্ড ইচ্ছে থেকে ওয়াহিদ ২০১৪ সালে শুরু করেন ‘টাইগার বো’। প্রথমে ‘ঐক্যতান’ নামে এটি পরিচিত ছিলো। যার প্রধান লক্ষ্য ছিলো সামাজিক পরিবর্তন। নারী কারিগরদের সাহায্য করা, বিভিন্ন ট্রেনিং দেয়া, তাদের কর্মের ন্যায্য মূল্য দেয়া এবং স্থানীয় ঐতিহ্যকে রক্ষা করা।

স্নাতক সম্পন্ন করেন নিজ এলাকার একটা কলেজ থেকে। তারপর হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক উদ্যোগ চ্যালেঞ্জ প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। মূল বিষয় ছিলো ঐক্যতানের উদ্দেশ্য নিয়ে। এবং তিনিই প্রথম এমন একটা প্রজেক্টে মেন্টরশীপ পেয়ে যান।

২০১৫ সালে সাবিনাকে সাথে নিয়ে তার এই পাইলট প্রজেক্টের কাজ শুরু করেন। প্রায় আড়াই মাস পর দেখা যায় এ উদ্যোগের মাধ্যমে সাবিনার উপার্জন ৫০% বেড়ে যায়। তখন ওয়াহিদের কাছে এটা চ্যালেঞ্জ হয়ে ওঠে যে কি ভাবে এটাকে একটা স্থায়ী রূপ দেয়া যায়। এসময় ওয়াহিদ সামাজিক পরিবর্তন এবং উদ্যোক্তা বিষয়ে উচ্চ শিক্ষার জন্য কলোরাডো তে ওয়াটসন বিশ্ববিদ্যালয়ে পাড়ি জমান। এবং সেখানেই ‘ঐক্যতান’ ‘টাইগার বো’ তে রূপ নেয়।

পণ্য তৈরী এবং নারী কারিগরদের উন্নত জীবন নিশ্চিত করতে সেই সাথে তাদের ভালোভাবে প্রশিক্ষণ দেয়া যেনো দেশের সংস্কৃতি রক্ষার সাথে তাদের স্থায়ী উপার্জনের একটা নিশ্চিত বন্দোবস্ত হয় তার সবটুকু হবে টাইগার বো এর মাধ্যমে।

মূলত ‘টাইগার বো’র কর্মীরা বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী কাতান কাপড় থেকে তৈরি করে বো-টাই। আন্তর্জাতিক মান সম্পন্ন এই বো-টাই গুলো আমেরিকা, কানাডার বাজারে বিক্রি হচ্ছে। ওয়াহিদ বলেন, ‘উদ্বোধনের দিনে আমি ৫টি বো টাই প্রদর্শনী করেছিলাম, যেগুলো মাত্র ৫মিনিটের মধ্যেই বিক্রি হয়ে যায়’। ২০১৬তে টাইগার বো প্রথম পার্টনার হিসেবে লন্ডন ভিত্তিক একটি বুটিক হাউজ ‘আর্টিশান এন্ড ফক্স ‘ কে পান

২০১৭ সালে বো টাইয়ের গুনগত মান আরও উন্নত হলে নর্থ আমেরিকার বাজার ধরতে সক্ষম হয় এবং পার্টনার হিসেবে আর্টিশান, জুয়েল এবং লোটাস এর মত ব্র্যান্ড গুলোর সাথে আউটলেট এবং অনলাইনে কাজ করা শুরু করে।

শতাধিক পরিবার এবং অসংখ্য অসহায় মহিলাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়েছে এই ‘টাইগার বো’ এর উদ্যোগে। এছাড়াও বাংলাদেশের কৃষ্টি সংস্কৃতিকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরছেন তারা। বর্তমানে নিউইয়র্কে ‘টাইগার বো’র ৫টি গ্লোবাল এম্বাসেডর নিযুক্ত আছেন। সামাজিক এই উদ্যোক্তা ওয়াহিদ হোসাইন বলেন, ‘টাইগার বো’ শুধু পণ্য তৈরির ক্ষেত্র নয়, বরং এটা একটি গল্প, এটি বাংলাদেশের এবং এর সংস্কৃতির গল্প, বাংলাদেশের নারী কারিগরদের জীবনের গল্প। কলোরাডোর লিডস বিজনেস স্কুল অব ইউনিভার্সিটিতে এমবিএ প্রোগ্রামে টাইগার বো’র বিষয়বস্তু নিয়ে পড়ানো হয়। কিভাবে ‘টাইগার বো’ স্থানীয় নারীদের দিয়ে বিলাসবহুল পণ্য তৈরির মাধ্যমে তাদের জীবনযাত্রার মানের উপর প্রভাব ফেলছে’।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে ওয়াহিদ হোসাইন বলেন, সম্প্রতি টাইগার বো ইয়ার রিং এবং ডিজাইনার শার্ট তৈরি করছেন। টাইগার বো’র পথ চলা কখনোই এত সহজ ছিলো না যদি সঠিক পথ নিরূপণ না হতো। এরকম গ্লোবাল এম্বাসেডর প্রোজেক্ট সম্পন্নসহ সাবিনার মত একজন উদ্যোক্তাকে পাওয়া যেটা টাইগার বো কে সফল করেছে। আমারা স্বপ্ন দেখি খুব শীঘ্রই বিশাল পরিসরে সুবিধা বঞ্চিত কারিগরদের সরাসরি সহায়তা করতে পারবো। সেই সাথে বাংলাদেশের গৌরবময় ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং পোশাক সারাবিশ্বে স্বীকৃতি পাবে।

সামাজিক এই উদ্যোগ গুলোকে সফল করার
জন্য সাম্প্রতি ওয়াই গ্যাপের (Y-gap) এক প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন। সারাদেশ থেকে অংশগ্রহণ করা হাজার হাজার প্রতিযোগিদের মধ্যে সামাজিক এই উদ্যোক্তা ওয়াহিদ হোসাইন প্রথম ১২তে স্থান করে নিয়েছেন। বাংলাদেশের সামাজিক উদ্যোক্তাদের স্বীকৃতি দিতে এবং তাদেরকে এগিয়ে নিতে ওয়াই গ্যাপ (ygap) কাজ করে চলেছে ২০১৬ সাল থেকে। এ পর্যন্ত তারা প্রায় ৭৫ জন সামাজিক উদ্যোক্তাকে স্বীকৃতি দিয়েছে।

 

বিপ্লব আহসান
স্পেশাল করেস্পন্ডেন্ট ,উদ্যোক্তা বার্তা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here