মার্চ মাসে বাংলাদেশে এস এম ই’র সব থেকে বড় আসর জাতীয় এস এম ই মেলা শেষ হলো। তখনই সারাবিশ্বে সবচেয়ে বড় তান্ডব শুরু করলো এক ভাইরাস। কোভিড -১৯। আমাদের দেশে করোনার প্রভাব মার্চে তেমন প্রকট আকার নেয়নি তখনও কেবল আক্রান্তের সংখ্যাটা শুরু হচ্ছিল। নিজের এবং ফ্যাক্টরির কর্মীদের নিরাপত্তার স্বার্থে একদিন মাস্ক কিনতে গিয়ে খেয়াল করলেন একজন এস এম ই উদ্যোক্তা যে স্বাভাবিক দামের তুলনায় প্রতিটি মাস্কের দাম তিন গুণ বেশি, ব্যাপারটা নাড়া দেয় ভীষণ।
উদ্যোক্তা হাসিনা মুক্তা’র ফ্যাক্টরিতে তখন বৈশাখের কাজ চলছিল পুরোদমে। দু-এক জায়গায় ঈদের অর্ডার নিয়েও কথা চলছে।চারপাশে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকে। উদ্যোক্তা চিন্তা করলেন মাস্ক বানিয়ে স্বল্পমূল্যে বিক্রয় করবেন। উদ্দেশ্য অসাধু ব্যবসায়ীদের থেকে নয়, সাধারণ মানুষ যাতে স্বল্প মুল্যে মাস্ক কিনে নিরাপদ থাকতে পারে। কাঁচামাল সংগ্রহ করতে গিয়ে দেখলেন সেখানেও দাম বেশি, বেশি দামে বাজার থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ করে মাস্ক তৈরি করলেন। বিভিন্ন সংস্থায় পাইকারি প্রতিপিস মাস্ক ১৬টাকা করে এবং খুচরা ২০টাকা করে বিক্রি শুরু করলেন। বাইরে প্রতিপিস মাস্ক বিক্রি হতো ৭০-৮০ টাকায়। নিজে বিক্রির পাশাপাশি অন্যান্য উদ্যোক্তাদের উৎসাহ দিলেন মাস্ক তৈরির, কাঁচামাল সংগ্রহ থেকে শুরু করে সকল ব্যাপারে সহযোগিতা করলেন নিজেই।যাতে সবাই একসাথে কম দামে বিক্রি করলে অন্য অসাধু ব্যবসায়ীরা দাম কমিয়ে দেয় এবং স্বল্পমূল্যে নিরাপত্তা উপকরণ সকলেই ব্যবহার করতে পারে। এই কাজে উদ্যোক্তা সফলতার দেখা পান।

করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত যোদ্ধাদের নিরাপত্তা ঝুঁকির খবর বিভিন্ন মাধ্যমগুলোতে যখন দেখলেন,ভাবলেন কিছু একটা করা দরকার। বড় বড় গার্মেন্টস গুলো কিছু করতে পারলেও একজন উদ্যোক্তার তাদের অনেক প্ল্যানিং দরকার বা দেশের বাইরে থেকে আনতে গেলেও তা সময় সাপেক্ষ, মুক্তা ভাবলেন একজন উদ্যোক্তা হিসেবে তিনি অল্প সময়ে নিজেই তৈরি করে এমন পরিস্থিতিতে দেশের সেবায় কিছু করতে পারেন।দরকার সাহস এবং ইচ্ছেশক্তি। ইন্টারনেটে বিভিন্ন মাধ্যমে দেখে পিপিই তৈরির জন্য প্যাটার্ন তৈরি শিখলেন।স্যাম্পল তৈরি করে অনুমোদনের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে গিয়ে প্রশংসিত হলেন।কাগজপত্রের অনুমোদন সময় সাপেক্ষ, তাই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মৌখিক অনুমোদনের পর বিক্রয় শুরু করলেন।নিজের সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট দিয়ে বেশ সাড়া পেলেন হাসিনা মুক্তা। প্রথম একজন ডাক্তার ১০পিস পিপিই নিলেন, পরবর্তীতে তার মাধ্যমে তার আরো সহকর্মীরাও নিলেন উদ্যোক্তার তৈরি পিপিই। এক উদ্যোক্তা বন্ধুর মাধ্যমে ঢাকা মেডিকেলে ৬০ জন ডাক্তারের কাছে সরবরাহ করলেন পিপিই। বিভিন্ন তরুণ স্বেচ্ছাসেবক টিমে ফ্রি তে দিলেন নিজের তৈরি করা পিপিই নারী উদ্যোক্তা হাসিনা মুক্তা।

দেশে করোনা মারাত্মক আকার ধারণ করায় বন্ধ হলো গণপরিবহন, সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হলো। কর্মীদের নিরাপত্তার কথা ভেবে, সবাইকে তাদের সম্মানী দিয়ে নিজের ফ্যাক্টরী বন্ধ করলেন উদ্যোক্তা। পিপিই’র অনেক অর্ডার আসতে থাকায় কিছু কর্মী সিদ্ধান্ত নিলেন তারা কারখানাতেই থাকবেন, সকল স্বাস্থ্যবিধি মেনে তারা কাজ করবেন এবং করোনা আক্রান্তদের সেবায় নিয়োজিত সকল যোদ্ধাদের এসময় পিপিই’র সাপ্লাই দিবেন। উদ্যোক্তা নিজেকে হোম কোয়ারেন্টিনে আবদ্ধ করলেন। অনলাইন এবং পরিচিত মাধ্যম থেকে পণ্যের অর্ডার নিয়ে কর্মীদের সাথে সবসময় ফোন কলে যোগাযোগ রাখতেন এবং সে অনুযায়ী পণ্য সাপ্লাই করতে থাকেন।
২৪ এপ্রিল উদ্যোক্তা জানতে পারেন বাড়ির সিকিউরিটির দায়িত্বে নিয়োজিত তিন জন সদস্যের মধ্যে একজন করোনা আক্রান্ত হাসপাতালে ভর্তি এবং বাকি দুজনের টেস্ট করলে তারাও করোনা পজিটিভ হয়।উদ্যোক্তার বাড়ির নিচতলায় বিদ্যুৎ অফিসের আবাসিক এবং অফিস থাকায় আরো ৮-৯ দিন পর জানা যায় সেখানে ৯জন সদস্য করোনা পজিটিভ, যারা তথ্য গোপন করেন।উদ্যোক্তা নিজ উদ্যোগে পুলিশকে জানালে তারা কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি বাড়িটিকে লকডাউন করেনি।

বিভিন্ন সময় কাজের প্রয়োজনে স্বাস্থ্যবিধি মেনেই বাইরে যেহেতু যাওয়া হতো তাই করোনা আক্রান্ত সদস্যদের সাথে উদ্যোক্তার একটা সংস্পর্শতা ছিলোই, একটু অসুস্থতা অনুভব করায় গত ৪মে উদ্যোক্তা মুগদা জেনারেল হাসপাতালে করোনা পরীক্ষা করেন। ২দিনের মধ্যেই রিপোর্ট দেবার কথা থাকলেও হাসপাতাল থেকে কোন রিপোর্ট দেওয়া হয়নি রিপোর্ট চাইলে বরং জানানো হয় আপনি করোনা নেগেটিভ। উদ্যোক্তা নিজের মধ্যে করোনার উপসর্গগুলো বুঝতে পেরে নিজেই সতর্ক চলাফেরা, নিরাপদ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এবং পারিবারিক ডাক্তারের পরামর্শে নিয়মিত ওষুধ সেবন করছিলেন। এর মধ্যে ১২দিন পর স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে কল করে তার শারিরীক অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়, বলা হয় আপনি একজন করোনা পেশেন্ট। উদ্যোক্তা বিচলিত হয়ে যান এবং হাসপাতালের নেগেটিভ রিপোর্টের কথা জানান। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দুঃখিত হন এবং প্রয়োজনীয় সকল তথ্য সেবা দিয়ে সহযোগিতা করেন।
১৪ দিন পর পরিবারের সকল সদস্যসহ ২য় টেস্ট করান। রিপোর্টে উদ্যোক্তা এবং তার বড় মেয়ে দুজনের করোনা পজিটিভ আসে এবং বাকি সদস্যরা নেগেটিভ। আইসোলেশনে চলে যান উদ্যোক্তা। মানসিক সাপোর্ট দিয়ে উদ্যোক্তার পাশে ছিলেন অনেকেই। মনোবল হারাননি উদ্যোক্তা,আইসোলেশনে থেকেও অনলাইনে অর্ডার সংগ্রহ করে পণ্য সাপ্লাই অব্যাহত রেখেছেন।

আইসোলেশনে থাকা উদ্যোক্তাকে করোনায় কর্মহীনদের কথা খুব ভাবায়। ঈদুল ফিতরের আগে তাদের জন্য কিছু করবেন চিন্তা করেন। উদ্যোক্তা বন্ধু রেশমা জাহান এবং নেয়ামত উল্লাহ বাবুর সাথে নিজের চিন্তা শেয়ার করেন।উদ্যোক্তা নিজে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের একজন সদস্য হওয়ায়, তাদের সাথেও শেয়ার করেন নিজ উদ্যোগের কথা। বাংলাদেশ ইয়ুথ এন্টারপ্রেনিওর ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন, যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর এবং আরো বেশ কিছু সংগঠনের সহায়তায় ঈদের দু’দিন আগে ১১০০কর্মহীন পরিবারকে ঈদ উপহার তুলে দেন।
যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সচিব আখতার হোসেন ও উদ্যোক্তাদের উপস্থিতিতে জুম কনফারেন্স এ উদ্যোক্তার উদ্যোগের উদ্বোধন করেন।

আইসোলেশনে থেকেও ব্যবসা বন্ধ হতে দেয়নি। দেশের প্রয়োজনীয়তায় বিকল্প কাজ করছেন উদ্যোক্তা। একসময় সেবামূলক চিন্তা করে শুরু করা কাজই ব্যবসায়িক সাপোর্ট দিচ্ছে উদ্যোক্তাকে। এখনো প্রতিনিয়ত কাজ করছেন, অর্ডার সরবরাহ করছেন।
গত দুদিন আগে তৃতীয় টেস্টে উদ্যোক্তাসহ পরিবারের সকল সদস্যদের করোনা নেগেটিভ রিপোর্ট আসে।
করোনাজয়ী উদ্যোক্তা হাসিনা মুক্তা বলেন, সকলের মানসিক সাপোর্ট টা খুব দরকার। করোনায় ভয়ের কিছু নেই, সচেতনতাই মূল ব্যাপার। ঘরে থেকে জরুরী ও নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে করোনা জয় সম্ভব। নিজে সচেতন হতে হবে, সুস্থ থাকুন, সুস্থ রাখুন।
জান্নাতুল ফেরদৌস তিথি
স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট