উদ্যোক্তা সুকান্ত বণিক

সাভারের ধামরাইয়ে কাঁসা পিতল দিয়ে পাল রাজাদের আমলের ঐতিহাসিক মূর্তি নতুন করে নিজ উদ্যোগে তৈরি করছেন সুকান্ত বণিক। সাভারের ধামরাইয়ের দুই’শ বছরের পুরানো একটি কারখানায় প্রায় ৪০ থেকে ৫০ টি মূর্তি বানানো হচ্ছে। যা বানাতে সময় লাগবে প্রায় এক বছরের বেশি।

ঢাকার অদূরে সাভারের ধামরাই বাজারের কেন্দ্রেই ‘ধামরাই মেটাল ক্রাফটস’ নামের একটি মালিকানাধীন কাঁসা-পিতলের কারখানা। এখানে কাঁসা-পিতলের বিভিন্ন মূর্তি সহ প্রয়োজনীয় দৈনন্দিন ব্যবহার্য তৈজসপত্র সহ ঘর সাজানোর সরঞ্জামাদি বানানো হয় গত প্রায় ২০০ বছর ধরে। প্রাচীন আমলের ডিজাইনের একটি বাড়ির ভেতর ঘরেই এর কারখানা। এসব জিনিসপত্র প্রায় ৫ হাজার বছর আগে আবিষ্কৃত প্রক্রিয়ায় বানানো হয়। যে প্রক্রিয়ায় একসঙ্গে অধিক পরিমাণে বানানো না গেলেও মানসম্পন্ন ও অত্যন্ত ক্ষুদ্র ডিজাইনের কারুকাজ সম্পন্ন জিনিসপত্র বানানো সম্ভব বলে জানায় কারখানাটিতে কর্মরত ৫ জন কারিগররা।

বাঙলার সেই ঐতিহ্যগত নিদর্শনগুলোকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে চেনাতে স্ব-উদ্যোগে কাজ করে যাচ্ছে ধামরাই মেটাল ক্রাফটস। শুধুমাত্র ছবি দেখে পাল রাজাদের বানানো কাঁসা-পিতলের মূর্তি বানাচ্ছে এই প্রতিষ্ঠানটি। তাছাড়া এই কারখানা বা ওই প্রাচীন ডিজাইনের বাড়িটিতেই হবে কাঁসা-পিতলের তৈরি জিনিসপত্রের একটি জাদুঘর। আর প্রতিষ্ঠানটির মালিকের মূল লক্ষ্য ঐতিহ্যগত এই কাঁসা-পিতলের পণ্যগুলোকে টিকিয়ে রেখে বাঙালী প্রাচীন সংস্কৃতিকে আরও শক্তিশালী করা।

ধামরাই মেটাল ক্রাফটে লস্ট ওয়াক্স পদ্ধতিতে এই মূর্তিগুলো বানানো হয়। এ পদ্ধতিটি প্রায় ৫ হাজার বছর আগের। কিন্তু স্বয়ংক্রিয় মেশিন ছাড়া এ পদ্ধতিতেই অত্যন্ত সূক্ষ্ম কাজ করা যায়। যদিও সময় অনেক বেশি লাগে। কিন্তু ক্ষুদ্র ডিজাইনের চমক দেখাতে এ পদ্ধতিটিই সেরা। এ পদ্ধতিতে প্রথমে মোমের তৈরি ছাচ বানাতে হয়। সেখানে গলিত কাসা পিতল ঢেলে সেটা ঠান্ডা হলে আবার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কাজ সম্পাদন করতে হয়। অনেক সময় ছাচ বা ডাইচ বানাতে ভূল হলে আবার প্রথম থেকে কাজটা করতে হয়।

বর্তমান সময়ে কাসা-পিতলের তৈরি জিনিসপত্রের ব্যবহার দেশে একেবারে নেই বললেই চলে। শুধুমাত্র উপমহাদেশের সনাতন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে ও কিছু কিছু অঞ্চলের মানুষদের কাছেই বেঁচে আছে পণ্যগুলো। যে কারণে ভারত এই ঐতিহ্যকে ধরে রেখে সুনাম কুড়ালেও পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। কেননা ঐতিহ্যগত জিনিসপত্র যে কোন দেশের সুনাম বাড়ায় বলে মত প্রকাশ করেন সংশ্লিষ্টরা।

মূলত প্রদর্শনী বা ঐতিহ্যকে ধারণ করার তাগিদ থেকেই এমন কাজ করা বলে জানালেন ধামরাই মেটাল ক্রাফটসের সত্ত্বাধিকারী সুকান্ত বণিক।

তিনি বলেন, বাংলাদেশ থেকে কাঁসা পিতল দিয়ে তৈরি পণ্যের ঐতিহ্য হারিয়ে গেছে শুধুমাত্র সেটা ফিরিয়ে আনার কাজ করছি আমি। কাঁসা-পিতলের জিনিসপত্র তৈরি করতে লস্ট ওয়াক্স, স্যান্ড কাস্টিং, পটারি কাস্টিং, হ্যামারিং ইত্যাদি পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। আমার লক্ষ্য শুধুমাত্র এই পণ্যগুলোর প্রদর্শন নয় এগুলো কিভাবে বানানো হয় সে সম্পর্কেও দেশের মানুষজন অবগত থাকবে, বিশেষ করে তরুণ সমাজ।

সুকান্ত বণিক আরো বলেন, তাছাড়া দেশে আসা কিংবা পিতলের দিয়ে তৈরি সবচেয়ে ভালো কাজ হয়েছে পাল রাজাদের আমলে। সেগুলো আবার আমি ফিরিয়ে আনার জন্য কাজ করছি। পাল রাজাদের মূর্তিগুলোর এক একটি সিরিজ করে আমি বানাবো। আমি হুবুহু সেসময়ের কাজগুলোর অবলম্বনে মূর্তিগুলো তৈরি করছি এবং একটি প্রদর্শনী করবো। এই প্রদর্শনী দেশে ও দেশের বাইরে করার ইচ্ছা আছে। এতে করে আমাদের এই ঐতিহ্য ব্যাপকভাবে সমাদৃত হবে।

দেশের কাঁসা-পিতল শিল্পের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি বলেন, কাঁসা-পিতল শিল্প বাংলাদেশ একটি রুগ্ন শিল্প না এটি একটি মৃত শিল্প। বাংলাদেশের যেখানে যারা এই কাজগুলো করছে তারা সাধারণত অন্য কোন কাজ করতে পারছে না বলেই ধরনের কোনো কাজ করছে। আবার কোন তরুণরাও এ কাজে আগ্রহী হচ্ছে না। কারণ বাংলাদেশের একজন রিকশাওয়ালা দিনে যে পরিমাণ টাকা উপার্জন করে কাঁসা-পিতলের পণ্য বানিয়ে বাজারে বিক্রি করে দিনে তার অর্ধেক পরিমাণ টাকাও উপার্জন করা সম্ভব নয়। সেখানে কারিগররা তো আরো কম টাকা পায়। আমাদের এখানে ২২ জন কারিগর ছিল। তার থেকে কমতে কমতে এখন মাত্র ৫ জন আছে। এবং এই যে ৫ জন কাজ করতেছে তাদের অবস্থাও খুব খারাপ। কেননা আমাদের প্রতিদিন কোন কাজ থাকেনা। মাঝে মাঝে অল্প বিস্তর কাজের অর্ডার থাকে।

এক্ষেত্রে কমপক্ষে আমাদের একটি উদ্যোগ দরকার যে উদ্যোগের মাধ্যমে এই ঐতিহ্যবাহী শিল্প সম্পর্কে দেশের মানুষজন জানতে পারবে এবং আগামী প্রজন্মকে জানানো সম্ভব হবে বলেও মন্তব্য করেন সুকান্ত বণিক।

ডেস্ক রিপোর্ট উদ্যোক্তা বার্তা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here