এসএসসি এবং এইচএসসি দুটো পরীক্ষাতেই বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে পাশ করেন মাহমুদা সুলতানা নাঈমা। ইচ্ছা ছিলো মেডিকেলে পড়ার। কিন্তু মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষায় চান্স হলো না। তারপর ঢাকার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ইডেন মহিলা কলেজে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে রসায়ন বিভাগে পড়ার সুযোগ পান। এরমধ্যে বিয়েও হয়ে গেলো তার।
বাবা ছিলেন একজন সরকারি ডাক্তার।বাবার কথা ছিলো তাকে ডাক্তার হতেই হবে। মেডিকেলে চান্স পাননি বলে তার পড়াশোনার প্রতি বাবার আগ্রহটা কমে গেল। আর বিয়ের পরে মেয়েদের বাচ্চা নেয়াটাই যেন সবার আগে। তাই তার মা ও শাশুড়ী বাচ্চার জন্য প্রচণ্ড প্রেসার দিচ্ছিলো। তারপর তিনি টুইন বেবি কন্সিভ করেন। তিনি চেয়েছিলেন পড়াশোনাটাও চালিয়ে যাবেন। কিন্তু অনার্স ৩য় বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষার কয়েক মাস আগেই তার ডেলিভারি হলো। ডেলিভারি হওয়ার আগের দিনও তিনি ক্যাম্পাসে গিয়েছিলেন একটা পরীক্ষা দিতে। তার একটা ছেলে ও একটা মেয়ে হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু ডেলিভারি হওয়ার ৩-৪ ঘন্টা আগেই মেয়ে বাবুটা মারা যায়। আর এজন্য সবাই তাকে দায়ী করে তার পড়াশোনাটা বন্ধ করে দেয়।
প্রচণ্ড ডিপ্রেশনে চলে যান নাইমা। সোশ্যাল মিডিয়া থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নেন। যেখানে এক সময় তিনি তার সব কিছু শেয়ার করতেন। একটা সময় মনে হল তিনি যদি নিজেকে নিয়ে না ভাবেন তাহলে অন্য কেউ তাকে নিয়ে ভাববে না। এরপর নিজের জমানো ৪৯০০ টাকা দিয়ে ব্যবসা শুরু করলেন। ২০২০ সালের ১ জুলাই থেকে উদ্যোগ শুরু করলেও নানান চড়াই উৎরাই পেড়িয়ে এপর্যন্ত এসেছেন। সব জায়গায় বাধা। এই ২ বছরের মধ্যে ভালো ভাবে কাজ করতে পেরেছেন ৬ মাসেরও কম সময়।
এখনো একাই সব সামলাচ্ছেন। নিজেই নিজের ফটোশুট করেন মোবাইলে টাইমার সেট করে। তার স্বামী এখন অনেক সাপোর্টিভ। তার সাপোর্ট না পেলে এতোটুকুও এগিয়ে যেতে পারতেন না। তার উদ্যোগের নাম ‘Elegant Attire By Naima’। মানে মার্জিত বেশভূষা। ব্যক্তিগত ভাবে তিনি একজন হিজাবি। তাই তিনি সেরকম পোশাকই রিপ্রেজেন্ট করতে চান। তার একটি ফেইসবুক পেইজ আছে। এছাড়াও তার পার্সোনাল ব্লগিং পেইজও আছে। যার নাম ‘Mahmuda Sultana Naima’। পাশাপাশি তার একটি সংগঠন আছে যার নাম “ছায়ানীড় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন” সেখানে তিনি ম্যানেজিং ডিরেক্টর হিসেবে আছেন।
তার পণ্য হলো ছেলে মেয়েদের দেশিয় পোশাক এবং হিজাব। এ পর্যন্ত তিনি প্রায় ৩০০ পিস হিজাব বিক্রি করেছেন। তার পেইজ-এর পণ্য সীতাকুণ্ড, টেকনাফ, রাজশাহী, গাজীপুর, বরিশাল সহ সারাদেশে ছড়িয়ে গেছে। দেশের বাইরেও অনেকেই নিতে চেয়েছেন। কিন্তু দেশের বাইরের সার্ভিস এখনো চালু করা হয়ে উঠেনি যেহেতু সেন্ডিং চার্জ অনেক বেশি। প্রতি মাসে প্রায় ত্রিশ হাজার টাকার মতো পণ্য বিক্রি হয়। চেষ্টা করছেন নিজের উদ্যোগকে আরও বড় করার।
উদ্যোক্তা নাইমার বাবা একজন সরকারি অবসর প্রাপ্ত ডাক্তার। মা গৃহিনী। তার জন্ম মুন্সীগঞ্জ জেলার সিরাজদিখান। শৈশব কেটেছে সেখানেই। ছোটবেলায় পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধূলা, অভিনয়, চিত্রাঙ্কন, বিতর্ক প্রতিযোগিতায়ও অংশগ্রহণ করতেন। একবার চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করেন। সেই সাথে বিতর্ক প্রতিযোগিতায় তার দল বিজয়ী হওয়ার পাশাপাশি তিনি শ্রেষ্ঠ বক্তা হিসেবে পুরস্কার পান। তবে তার বাবা বেশ ধার্মিক। তাই তার এক্সট্রা কারিকুলাম এক্টিভিটিসগুলো ৫ম শ্রেণী পর্যন্তই শেষ হয়ে যায়। বাবা-মার সাপোর্ট না পাওয়াতে সেগুলোতে আর অংশগ্রহণ করা হয়নি।
নিজের উদ্যোগ সম্পর্কে উদ্যোক্তা বলেন, ‘আমার পেইজ-এ বর্তমানে ১২ হাজারের অধিক ফলোয়ার আছেন। নিজেকে এখনো সফল দাবি করছি না। অনেক দূর যাওয়া বাকী। তবে আলহামদুলিল্লাহ আমার পণ্যের পজিটিভ রিভিউ পেয়ে যাচ্ছি প্রতিনিয়ত। যেটা আমাকে অনেক অনুপ্রেরণা দেয়। আমি চাই আস্তে আস্তে এগাবো কিন্তু সৎভাবে এগাবো। কাউকে ঠকিয়ে একবারের জন্য বিজনেস করতে চাই না। আমার এপর্যন্ত কাস্টমার সংখ্যা প্রায় ৩০০জন। যার মধ্যে প্রায় ৫০ জনই রিপিট কাস্টমার। এখনো আমি আমার বাবা মার থেকে সাপোর্ট পাইনা। নিজের ব্র্যান্ডিং নিজে করি বলে আমাকে অনেক কথা শুনতে হয় কাছের মানুষদের কাছ থেকে। কিন্তু আমি এখন আর এগুলোর জবাব দেই না। আমি চাই আমার কাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে। যেন আমার কাজের ফলাফলটাই এই কথাগুলোর জবাব দিবে ইনশাআল্লাহ।’
সাইদ হাফিজ,
উদ্যোক্তা বার্তা