ইউটিউব দেখে সিড লেস লেবু চাষ করে লাখপতি

0
উদ্যোক্তা মশিউর রহমান

সিড লেস বা বীজ ছাড়া ‘চায়না-৩’ জাতের লেবুর বাগান করে সফলতা পেয়েছেন নওগাঁর নিয়ামতপুরের কৃষি উদ্যোক্তা মশিউর রহমান। গত আড়াই বছরে তার বাগান থেকে প্রায় আড়াই লাখ টাকার লেবু বিক্রি হয়েছে। তার সফলতা দেখে এলাকার বেকার যুবকরা লেবুর বাগান করার ইচ্ছা প্রকাশ করছেন।

বরেন্দ্র এলাকায় পানির গভীরতা অনেক নিচে থাকায় ফসল ঠিক মতো না হওয়ায় একটিমাত্র ফসল বৃষ্টি নির্ভর আমন ধানের আবাদ করা হয়। যেখানে ফলনও ঠিক মতো পাওয়া যায় না।বছরের বেশির ভাগ সময়ই জমিগুলো অনাবাদি থাকে। তাই ধানের আবাদ কমিয়ে এখন বিভিন্ন ফলের বাগান করে লাভবান হচ্ছেন কৃষি উদ্যোক্তারা।কৃষি উদ্যোক্তা মশিউর রহমান বলেন, ‘২০০৫ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করি। ২০০৬ সালে বাবা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ায় সংসারের দায়িত্ব আমাকে নিতে হয়। প্রথম দিকে ধান আবাদের চেষ্টা করি কিন্তু পানির সংকট হওয়ায় ধানের আবাদ ঠিক মতো হতো না। বিঘাপ্রতি ১০-১৪ মণ ধান পাওয়া যেতো। পরিশ্রমও বেশি হতো। আবার ধানের দামও ভালো পাওয়া যেতো না। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম ভিন্নকিছু করবো। এমন চিন্তা-ভাবনা থেকে ইউটিউব দেখে লেবু চাষের চিন্তা মাথায় আসে। তাই পরে ধানের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে বাগানের দিকে ঝুঁকে পড়লাম।’

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, নওগাঁ জেলায় ১৭২ হেক্টর জমিতে লেবুর বাগান রয়েছে। এর মধ্যে সদর উপজেলায় ২৫ হেক্টর, রানীনগরে ২ হেক্টর, আত্রাইয়ে ১০ হেক্টর, বদলগাছীতে ৬৫ হেক্টর, মহাদেবপুরে ১০ হেক্টর, পত্নীতলায় ১০ হেক্টর, ধামইরহাটে ১২ হেক্টর, সাপাহারে সাড়ে ৫ হেক্টর, নিয়ামতপুরে ২৪ হেক্টর, পোরশায় ৬ হেক্টর এবং মান্দায় ২ হেক্টর জমিতে লেবুর চাষ হয়েছে।

নওগাঁ জেলার নিয়ামতপুর উপজেলার রসুলপুর ইউনিয়নের এক প্রত্যন্ত গ্রামের ঈসমাইল হকের ছেলে মশিউর রহমান। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। ইউটিউবে সিড লেস লেবু চাষে সফলতা দেখে লেবু চাষের আগ্রহ জন্মে তার। জেলার বদলগাছী উপজেলা থেকে ২৫ টাকা পিস হিসেবে ৬০০ পিস চারা কেনেন। গর্তের মাটির সঙ্গে জৈব সার, গোবর, ডিএপি, এমওপি, ইউরিয়া, জিপসাম, দস্তা ও বোরন মিশিয়ে কিছুদিন জমি ফেলে রাখেন। এরপর বেড তৈরি করে নির্দিষ্ট দূরত্বে ২০১৯ সালের আগস্ট মাসে ওই চারাগুলো সাড়ে চার বিঘা জমিতে রোপণ করেন। চারা লাগানোর ৬ মাস পর গাছে ফুল আসা শুরু হয়। সে সময় প্রথমবারের মতো ২৩ হাজার টাকার লেবু বিক্রি করা হয়। দ্বিতীয় দফায় ৫০ হাজার টাকা এবং তৃতীয় দফায় ৬০ হাজার টাকার লেবু বিক্রি করেন। এ পর্যন্ত প্রায় আড়াই লাখ টাকার মতো লেবু বিক্রি করেছেন মশিউর রহমান।

মশিউর বলেন, ‘আমি সাড়ে ৪ বিঘা জমিতে ৬০০ পিস সিড লেস লেবুর চারা লাগাই। চারা কিনে লাগানো, সার, ঔষধ, শ্রমিক ও জমিতে বেড়াসহ প্রায় ১ লাখ টাকা খরচ হয়েছিল। খরচ বাদ দিয়ে এখন লাভের মুখ দেখছি। আমার কাছে মনে হয়েছে লেবু চাষ লাভজনক। ধানের মতো পরিশ্রম করতে হয় না। এমনকি দাম নিয়েও দুশ্চিন্তা করতে হয় না। বাগানে এসে ব্যবসায়ীরা লেবু কিনে নিয়ে যান। এছাড়া হাটে নিয়েও বিক্রি করা হয়। সব মিলিয়ে পরিশ্রমও কম হয়।’

এই লেবু চাষে বছরের ২-৩ বার সার ও সেচ দিতে হয়। দেশে যত জাতের লেবু আছে তার মধ্যে এ জাতের লেবুর ধারণ ক্ষমতা বেশি এবং সারা বছর পাওয়া যায়। বর্তমানে তার গাছে প্রায় দেড় লাখ টাকার মতো লেবু আছে। আগামী কয়েকদিনের মধ্যে বিক্রি করার উপযোগী হবে। গাছ যত বড় হতে থাকে লেবুর আসার সংখ্যা বাড়তে থাকে। বিভিন্ন এলাকা থেকে লেবুর বাগান দেখতে আসছেন এবং পরামর্শ নিয়ে যাচ্ছে। অনেকেই এখন লেবু চাষে উৎসাহিত হচ্ছেন। বেকার তরুণদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘লেবুর পাশাপাশি দুই বিঘাতে আমের বাগান করেছি। যেখানে হাঁড়ি ভাঙা ২০০টি, বারি-৪-৩০০টি এবং আম্রপালি ২০০টি গাছ আছে। শিক্ষিত বেকার যুবকরা চাকরির পেছনে না ছুটে জমি লিজ নিয়ে মিশ্র ফলের বাগান করেন তাহলে তারা লাভবান হতে পারবেন বলে আশাবাদী।’

গ্রামের স্থানীয়রা বলেন, ‘আমাদের গ্রামের এই একটি লেবুর বাগান মশিউর ভাইয়ের। বাগানে থোকায় থোকায় লেবু ঝুলে আছে। আশ্চর্যের বিষয় হলো লেবুতে বীজ নাই এবং আকারেও অনেক বড়। লেবুর সুগন্ধ এবং রসও প্রচুর। তার কাছে পরামর্শ নিই কিভাবে লেবু চাষ করে সফল হওয়া যায়। তবে লেবু চাষ লাভজনক বলে মনে হচ্ছে।’

এক সময় এই এলাকার জমি বছরের বেশিরভাগ সময় অনাবাদি থাকতো। গত কয়েক বছর থেকে আম, বরই, লেবু ও পেয়ারাসহ অন্যান্য ফলের বাগান গড়ে উঠছে। চাষিরা মিশ্র ফলের বাগান করে ধানের থেকে লাভবান হচ্ছেন। নিয়ামতপুর উপজেলা কৃষি অফিসার আমির আব্দুল্লাহ মো. ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, বরেন্দ্র এলাকায় পানির স্বল্পতার কারণে এখন চাষিরা বিভিন্ন ফলের বাগান করার আগ্রহী হচ্ছেন। লেবু চাষি মশিউর রহমানকে কৃষি অফিস থেকে লেবু চাষে সার্বিক পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া এলাকার যেসব চাষিরা ফলের বাগান করতে আগ্রহী তারা অফিসে যোগাযোগ করলে সার্বিক সহযোগিতা করা হবে।

সেতু ইসরাত,
উদ্যোক্তাবার্তা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here