পথেঘাটে চলতে ফিরতে শোনা যায় আমার বাচ্চা এইটুকুনই বয়স থেকে নাচতে পারে, স্টেজে গাইতে পারে, সুন্দর কবিতা পড়তে পারে….. হরহামেশাই শোনা যায় শিশু-কিশোরদের নানান গুণের কথা। আজ আমরা ভিন্নগুণে গুনান্বিত এক চৌকস সাজেদুর রহমানের কথা জানব। যে কিনা মাত্র ক্লাস সেভেনে পড়া অবস্থায় ব্যবসা জীবনের সূচনা করেছিলেন। ক্লাস সেভেন এ পড়বার সময় বিয়ে বা বিভিন্ন উৎসবের তাঁরা বাতি, আতশবাজির ছোট্ট সরবরাহ দিয়ে পথ চলা শুরু করেছিলেন যে কিশোর সে আজ কেমন আছে?
২০০২ সালের কথা। আই.ইউ.বি গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্ট থাকা অবস্থায় ইনডেন্টিং ব্যবসা, কমিশন এজেন্ট হিসেবে বিদেশী নানা কোম্পানির পণ্যের স্থানীয় এজেন্ট হন। পি.ডি.বি. এবং আর.ই.বি. রুরাল ইলেক্ট্রিফিকেশন বোর্ডে ছাত্র অবস্থায় ইন্টারন্যাশনাল টেন্ডারে নানান সর্বরাহের কাজে অংশ নেয়া ব্যবসায়িক মনে যে স্ফুরণ তার আলো দেখেছেন উদ্যোক্তা ছাত্র বয়সেই। ব্যবসা চালালেন ২০০৮ সাল পর্যন্ত। আইউবি থেকে পাশে করে বের হয়ে যখন সহপাঠীরা চাকরী জীবন শুরু করার কথা ভাবছেন তখন উদ্যোক্তা হবার বাসনাটি তীব্র অনুভূতিতে পরিণত হলো। ব্যবসা করতে থাকলেন ছোট্ পরিসরে।
মা কে নিয়ে পবিত্র হজ্বব্রত পালন করতে গেলেন কাজী সাজেদুর রহমান। রোজা রেখে মদিনা মনোয়ারায় মসজিদে নববীতে ইফতার করবার সময় একজন আরব তুলে দিলেন দুটি কাপ ইফতারের জন্য। পবিত্র হজ্বব্রত পালন করে দেশে ফিরে সেই স্মৃতি টাই ভাবিয়ে তুললো তরুণ সাজেদুর কে। মনে মনে কর্মব্রত ঠিক করে ফেললেন।
ব্যাংকের কাছে একটি ক্ষুদ্র শিল্প-স্থাপনার প্রস্তাব করলেন, করলেন ঋণের আবেদন। লোন পাশ হলো, অত্যন্ত লাগশই প্রযুক্তি এবং টেকশই, যুগোপযোগী প্রস্তাবনার কারণে। ইন্ডেন্টিং ব্যবসা নয়, নিজের পণ্য উৎপাদনশীল ব্যবসার পছন্দ এবার তরুণ উদ্যোক্তা সাজেদুর রহমানের।
দেশের মানুষের জীবন মানের উন্নতি হবে, কর্ম-সংস্থান সৃষ্টি হবে এবং সেটা অবশ্যই হবে পরিবেশ বান্ধব। তিন জন কর্মী সাথে নিজে একজন, চার জনার কর্মী বাহিনী নিয়ে যাত্রা শুরু করলেন ডিস্পোসিবল পেপার কাপ বা কাগজের তৈরি কাপ উৎপাদনের ফ্যাক্টরি। শুরু হলো KPC নাম দিয়ে উদ্যোক্তার স্বপ্ন ভরা চোখে দৃঢ় পথ চলা।
শুরুতে চীন থেকে আনা মেশিন-স্থাপনা যার মূল্য ৩০ লক্ষ টাকা এছাড়া পুরোটাই মনোবল এবং অদম্য বিশ্বাস। মেশিন স্থাপন করলেন তেজগাঁও লিংক রোড এ ১২০০ স্কায়ার ফিটে। উৎপাদন শুরু হলো কাগজের কাপ তৈরির ফ্যাক্টরিতে। উদ্যোক্তার স্বপ্নের পণ্য ডিস্পোসিবল পেপার কাপ।
২০১১ সালে, মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে এশিয়ান পেপার কাপ তৈরির জায়ান্ট মালেক্সে উদ্যোক্তা তিন মাসের এক নিবিড় প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন শিক্ষানিবেশ ব্যবসায়ী হিসেবে। তা আজ এক স্বর্ণ শিক্ষণ হিসেবে কাজ করা শুরু করে যেন। প্রতিদিন তেজগাঁও লিংক রোডে ২০ হাজার পিস কাগজের কাপ তৈরি শুরু করলেন উদ্যোক্তা কাজী সাজেদুর রহমান তার ফ্যাক্টরী KPC তে। দৈনিক ৭ ঘন্টার কঠোর পরিশ্রম। উৎপাদন, অফিস ব্যবস্থাপনা, কর্মী বাহীনির অনুপ্রেরণা, বাজার ব্যবস্থাপণা সকলে মিলে এক সাথে এগিয়ে যাবার মোটিভেশন, ব্যাংক ব্যবস্থাপণা নিজেই অত্যন্ত সফলতার সাথে দক্ষতার সাথে পরিচালনা করতে থাকেন উদ্যোক্তা কাজী সাজেদুর রহমান। একটি মোটরসাইকেল নিয়ে সারাদিন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং বাজারে নিজের উৎপাদিত পণ্যের বিপণন এবং সরবরাহের সকল মিটিং সম্পন্ন করতেন উদ্যোক্তা।
শুরুতেই সাড়া মিললো ব্যাপক। প্রথম অর্ডার আসল শেভরন থেকে। প্রতি মাসে শেভরন নিলো ৪ লাখ কাগজের কাপ। অর্থাৎ বছরে ৩৬ লাখ পিস কাপের অর্ডার উদ্যোক্তার চলার পথের ব্যবসার মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়াবার অনুপ্রেরণা। বড় স্বপ্ন, উদ্ভাবনী দৃষ্টি এবং কর্মনিষ্ঠা খুলে দেয় সফলতার পথ, দেখায় সফলতার সোনার হরিণকে সামনে। উদ্যোক্তা কাজী সাজেদুর রহমান এর জীবনেও ঠিক তেমন টাই ঘটেছে। একে একে গ্রাহক হলেন, পেপসি, নেসলে, ইউনিলিভার, ইস্পাহানি, ইগলু, নিউজিল্যান্ড ডেইরি, প্রান, আকিজ গ্রুপ, আনোয়ার গ্রুপ, বসুন্ধরা, বুমার্স, বিএফসি, ওয়েস্টিন, প্যান-প্যাসিফিক কেপিসির গ্রাহক। কর্মী সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২ জন। মাত্র ছয়টি মাসে উৎপাদন বেড়ে দাঁড়ালো প্রতিদিন গড়ে ১ লক্ষ ২০ হাজার পিস কাগজের কাপ তৈরি। উদ্যোক্তার নিরলস, পরিশ্রম বাজার সম্প্রসারণে নিয়মিত যোগাযোগ, সময় ও আন্তর্জাতিক মান নিয়ন্ত্রণ পরিবেশ বান্ধব পণ্য উৎপাদন বয়ে আনলো উদ্যোক্তার প্রতিষ্ঠান কেপিসি ইন্ডাস্ট্রির সুনাম। এগিয়ে চলেন উদ্যোক্তা এক দূর্দান্ত গতিতে।
দুই বছরে সত্তর টি দেশী এবং বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান হলো উদ্যোক্তার প্রতিষ্ঠান কেপিসির গ্রাহক। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পা রাখলেন উদ্যোক্তা ২০১৬ সালে। দুবাই এবং নেপাল থেকে পেলেন অর্ডার। ২০১৬ সালে জাতীয় এসএমই উদ্যোক্তা পুরস্কার অর্জন করলেন।
১২শ স্কয়ার ফিটে তিনটি মেশিন ছিল শুরুর দিন, মধ্যবর্তী সময়ে ৪২শ স্কয়ার ফিটে সাতটি মেশিন এবং কর্মী সংখ্যা ৩২ জন।
মাত্র ত্রিশ লক্ষ টাকা পেয়েছিলেন ব্যাংকের প্রথম ঋণ হিসেবে। ব্যাংক থেকে ব্যাংকেবল প্রোজেক্ট অনুমোদন পেয়ে এবং বিনিয়োগ নিয়ে যাত্রা শুরু করে ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানটি আজ বাজার ব্যবস্থাপনা, পণ্য এবং অর্ডার সব মিলিয়ে ৪ কোটি টাকা মূল্যমানের ব্যবসা পরিচালনা করছেন উদ্যোক্তা বার্তার এক জন সফল উদ্যোক্তা কাজী সাজেদুর রহমান। কারখানা এবং অফিস আজ ১২০০ বর্গফুট থেকে হয়েছে ১৬০০০ বর্গফুট। সহযোদ্ধা আজ ৪জন থেকে ৩৮জন।
২০১৬ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তা জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত উদ্যোক্তার কাছে তার সফলতার যাত্রা ছিল উদ্যোম আর স্বপ্নে এক সফল উদ্যোগের। তিনি বলেন, “আমি সবসময় মনে করতাম যে, ভালো কিছু করব। প্রোডাকশন জাতীয় পণ্য উৎপাদন করার চিন্তাই ছিল মূল। এবং ভালো পণ্য খোজার জন্য সবসময় উদগ্রীব থাকতাম আর সেই পণ্যের খোঁজ পেয়ে যাই পবিত্র হজ্জে গিয়ে।
ব্যবসার জন্য অবশ্যই বিনিয়োগ দরকার ছিল। ব্যাংক থেকে লোন নেয়ার জন্য প্রথমত আমি একটা প্রোফাইল তৈরি করি, এবং প্রোফাইলের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যা, পরিবেশকে বাঁচাও এবং পরিবেশ বান্ধব পণ্য তৈরি, এই মূল বিষয় গুলো লক্ষ্যণীয় করে তুলে ধরি। উদ্যোক্তাদের পরিবেশ বান্ধব পণ্য উৎপাদন অর্থাৎ গ্রীন প্রোজেক্ট গুলোতে কাজ করার জন্যে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং অন্যান্য ব্যাংক গুলো আর্থিক ভাবে সহযোগীতা এবং আগ্রহ প্রদান করার চেষ্টা করেন। যেহেতু আমি পরিবেশ বান্ধব পণ্য উৎপাদনের উদ্দেশ্যে ব্যাংকের নিকট ঋণ গ্রহণের প্রস্তাব রাখি এবং পণ্য সম্পর্কিত সকল বিষয়ে অবগত হয়ে ঋণ প্রদান করেন। তাদের সহযোগিতা আর আমার দৃঢ়তা এই দিয়ে যে যাত্রা শুরু হয়েছিল সে পথচলায় এগিয়ে যাচ্ছি আপনাদের দোয়ায়…..”
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জানতে চাইলে উদ্যোক্তা সাজেদুর রহমান উদ্যোক্তা বার্তা কে জানান, “কেপিসি কে তিনি এমন একটি জায়গায় নিয়ে যেতে চান, যেন সবার কাছে এটি একটি অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে, নতুন কোন উদ্যোগ নিয়ে সফল হওয়া যায়।”
একজন উদ্যোক্তার জন্য মূলধন তেমন কোন বড় বিষয় নয়, উদ্যোগ টাই যেন সব। একজন উদ্যোক্তার সর্বপ্রথম যা থাকতে হবে তা হল সততা, কঠোর পরিশ্রম, চিন্তা শক্তি। সঠিক সময়ে সঠিক উদ্যোগ, সাহস, ধৈর্য, পরিশ্রম এবং আলোচনার মাধ্যমে যে কোন ব্যবসা শুরু করলে সফলতা আসবেই।