অনেকটা মুখ ভেঙিয়েই বলি আমরা, “গ্রামে থেকে কিস্যু হয় না! কিছু করতে চাও? বড় শহরে বসতি লাগবে, মোটা অংকের টাকা লাগবে, বড় বড় লোকজনের সাথে পরিচিতি আর উঠাবসাও চাই!” আমি একজন রুমানা খাতুনকে চিনি। বয়স কতই হবে! তোমার আমার মতোই সদ্য কৈশোর পেরোনো তরুণ! নিভৃত এক পল্লীর মেয়ে। হাতে ছিল না লক্ষ লক্ষ টাকার মূলধন কিংবা শহুরে বসবাস। সবে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে স্বপ্ন দেখছিলেন, দু’চোখ ভরা স্বপ্ন…..

হঠাতই ময়মনসিংহে সাত দিন ব্যাপী জীবন দক্ষতা উন্নয়নের একটি ট্রেনিং এর কথা জানলেন রুমানা। সদ্য পাশ করা রুমানা এই বিষয়টির ওপর ট্রেনিং নিতে আগ্রহ দেখালেন। পরিবারের সহায়তায় ট্রেনিং এ অংশ নেওয়া হল রুমানার। ট্রেনিং শেষে মতামত জানতে চাওয়া হল ত্রিশ জনের কাছে। রুমানা লিখলেন, সুলভ মূল্যে গ্রামের মেয়েরা যাতে স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করতে পারে এমন একটি ফ্যাক্টরি দিতে।

উদ্যোক্তার তৈরি করা ‘অপরাজিতা’ স্যানিটারি ন্যাপকিন

দীর্ঘ সাত দিন ট্রেনিং শেষ হবার পর সবাই কে একটা করে মন্তব্য লিখতে বলা হয়।
ঐ সময় রুমানা মন্তব্যে লিখেছিলেন, “আমাদের গ্রাম অঞ্চলের যে মেয়েরা আছে তারা অনেকেই দরিদ্র পরিবারের এবং অনেক ধরণের সুবিধা থেকে বঞ্চিত। যেমন টাকার জন্য প্যাড কিনতে পারে না বা স্বাস্থ্যসম্মত কোন কিছু ব্যবহার করতে পারে না। সেই চিন্তা থেকে বলেছিলাম যে, আমি যদি স্যানিটারি ন্যাপকিন টা তৈরি করি আর সেটা যদি কম মূল্যের হয় এবং এটা যদি প্রত্যন্ত অঞ্চলের সুবিধা বঞ্চিত মেয়েদের মাঝে ছড়িয়ে দেই তাহলে তারা স্বাস্থ্য সচেতন হবে।”

২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে এই সুযোগটি নিয়ে উন্নয়ন সহযোগী টিম এসে রুমানাকে খুঁজেন বের করেন এবং তাকে জানানো হয় যে তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তাকে একটি ট্রেনিং দেওয়া হবে। এই ট্রেনিং করার জন্য রুমানার সাথে লাগবে আরো ১৫ জন মেয়ে। রুমানা তার কিশোরী ক্লাবের ১৫ জন মেয়ে এক সাথে হয়ে ট্রেনিং সম্পন্ন করেন। ট্রেনিং চলাকালীন দ্বিতীয় দিন আসে প্র্যাক্টিক্যাল অ্যাকশন। তখন রুমানার আবেদন ছিল, যেহেতু তারা সবাই দরিদ্র পরিবারের, তাই এখানে ৫ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে তারা ব্যবসাকে দাঁড় করাতে পারবে না। রুমানা বলেছিলেন অন্ততপক্ষে যদি মেশিনারিজ গুলো তাদের দেয়া হয় তাহলে পরবর্তীতে কার্যক্রম তারা নিজে থেকে করে নেবে।

প্যাড তৈরির মেশিন

বিষয়টি প্র্যাক্টিক্যাল অ্যাকশন বাংলাদেশ বিবেচনায় আনেন এবং পরে তারা ৩ টা মেশিন তুলে দেয় রুমানাদের হাতে। ট্রেনিং নেয়া হয়েছে, এখন স্বীয় উদ্যোমে স্বপ্নের যাত্রা কে বাস্তবে পাল তোলা। তুলা রিফাইনিং মেশিন, অটোক্লেভ মেশিন, আর একটি হচ্ছে ড্রাই মেশিন হাতে পেয়েই ৫ হাজার টাকার কাঁচামাল নিয়ে এসে কাজ শুরু করে দেন রুমানা ও তার ক্লাব মেম্বাররা। করলেন প্রথম বাণিজ্যিক ভাবে উৎপাদনের সূচনা।

কর্মীদের প্যাড তৈরির কর্মব্যস্ততা

প্রথম ধাপে মেডিক্যাল গঠন, লুস তুলা, নেট, গার্ডার, ফিতা পর্যায় ক্রমে প্যাড গুলো তৈরি করা শুরু হলো। মেডিক্যাল কটন দিয়ে সাইনটিফিক মেজারমেন্টে কেটে নিয়ে পার্ট তৈরি করা হয়, এরপর লুস তুলা রিফাইনিং করে মেডিক্যাল কটনের ভেতর স্থাপন করা। সহজে নেটের আবরণ তৈরি করবার জন্য এক অসাধারন প্রক্রিয়া, একটি গ্লাসের মাপে নেটটিতে তুলা স্থাপন, গার্ডারটিকে সেলাই মেশিন দিয়ে সেলাই করে প্রস্তুত করতে শুরু করলেন স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটারি ন্যাপকিন।

তুলা রিফাইনিং মেশিন

রুমানা খাতুনের ফ্যাক্টরি এগিয়ে চলে। এরপর অটোক্লেভ মেশিনে বিশুদ্ধকরণ প্রক্রিয়ার  মধ্য দিয়ে পণ্য এগিয়ে যায় তৈরি হবার পরবর্তী ধাপে ড্রাই মেশিনে। ড্রাই মেশিনে শুকিয়ে প্যাকেট জাতকরণ। প্রথম মাসেই প্রোডাকশন করলেন প্রায় ৫০০ প্যাকেট। শুধু মাত্র পণ্য তৈরি করবেন তা নয়, স্বপ্ন ভরা চোখে নিজের পণ্যের নাম দিলেন “অপরাজিতা”।
প্রথম মাসে পণ্য বেশি তৈরি করে ফেলেছিলেন। দ্বিতীয় মাসে ১৫০ প্যাকেট, এইভাবে চলতে থাকে ফ্যাক্টরির প্রোডাকশন। নিজের বাজার তৈরি করবার জন্য নিকটবর্তী স্কুল গুলোতে, ব্র্যাক কিশোরী ক্লাবের সাথে এবং তার সাথে ফার্মেসি ও বিউটিপার্লার গুলোতে নিজের পণ্য সাপ্লাই দিতে থাকেন রুমানা খাতুন। জেনারেল হাসপাতাল গুলোতে যোগযোগ করতে থাকেন নিভৃত পল্লীতে স্বাস্থসম্মত ভাবে তৈরি করা স্যানিটারি ন্যাপকিনের প্রথম বড় চালান সাত মাস পরেই দিতে হলো রুমানাকে।

রংপুর সদর থেকে ১০০০ প্যাকেটের একটা অর্ডার এবং তা সময় মত উৎপাদন ও সরবরাহ উদ্যোক্তা রুমানাকে করল আত্মবলে বলিয়ান। পেছনে ফিরে তাকানো আর নয়। রুমানা এবং সীমা দুই বোন দিনে ৮-৯ ঘন্টা করে সময় দিতে থাকেন ফ্যাক্টরিতে। সেই সাথে ট্রেনিং প্রাপ্ত ২০ জন কর্মীর কর্ম-সংস্থান করেছেন।

সকলে মিলে স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটারি ন্যাপকিন তৈরি করছেন

মাসে এখন রুমানার ফ্যাক্টরিতে উৎপাদন হয় সাড়ে তেরশ প্যাকেট স্যানেটারি ন্যাপকিন বিএসটিআই এর অনুমোদন মিলে গেল প্রায়। আজ রুমা, সীমা, সান্তনা, সান্তা বেগম, হাফিজা, শাপলা, আফরোজা, রেখা, মর্জিনা, মনির, জনি আলম, রতন এমন অনেকের প্রতিদিনের কর্মসংস্থান হয় অপরাজিতা স্যানিটারি ন্যাপকিন সেন্টারে। এরই মাঝে বাংলাদেশ স্টার্টআপ কাপ ২০১৭ সালে প্রথম হলেন রুমানা। সেখান থেকে পুরষ্কার মিললো ২৫ হাজার টাকা। পুরষ্কারের টাকাটি বড় নয়। সেখান থেকে নতুন আরও যোগাযোগ বলে দেয়, দেশের সকল বিভাগে নিজের পণ্য পরিচয় করিয়ে দেবার সম্ভাবনার কথা।

চোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে এক তরুণ উদ্যোক্তা আজ ২০ জন কর্মী নিয়ে পরিচালনা করছেন তার ব্যবসা। দেখিয়ে দিয়েছেন কি করে নিভৃত পল্লী থেকে শহর পর্যন্ত নিজের পণ্য কে চেনানো যায়। নিজের পণ্যে নারী সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করার পাশাপাশি রুমানার উদ্যোগ এক দূরন্ত সম্ভাবনায় হাতছানি দিয়েছে হাজারো স্বপ্নকে। ভালো আছেন স্বনির্ভর রুমানারা। ভালো আছেন নিভৃত সেই পল্লীতে রুমানার কর্মীবন্ধুরা “অপরাজিতা” র কর্মসংস্থানে।

 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here